আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-কমন কার্প মাছের প্রণোদিত প্রজনন :
কমন কার্প মাছের প্রণোদিত প্রজনন
কমন কার্প চাষযোগ্য মাছের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল। আমাদের দেশে আবহাওয়ায় কমন কার্প এক বছরের মধ্যে প্রজনন পরিপক্বতা লাভ করে । এরা ৪-৫ বছর সময়ের মধ্যে ১৩-১৪ কেজি ওজনের থেকে পারে । এরা বছরে ২ বার প্রজনন করে । ১ম বার ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এবং ২য় বার জুলাই থেকে আগস্ট মাস ।
আমাদের দেশে এই মাছের কয়েকটি জাত আছে তার মধ্যে স্কেল কার্প, মিরর কার্প ও লেদার কার্প উল্লেখ যোগ্য । বাণিজ্যিকভাবে কমন কার্প প্রজননের জন্য প্রণোদিত প্রজনন প্রক্রিয়া অনুসরন করা হয় ।
কমন কার্প মাছের প্রণোদিত প্রজননের ধাপ সমূহ নিম্নরূপ:
১। ব্রুড মাছ সংগ্রহ :
ক. প্রাকৃতিক উৎস থেকে অর্থাৎ নদ-নদী বা প্লাবন ভূমি প্রভৃতি থেকে বন্য জাতের মাছ সংগ্রহ করা হয় ।
খ. হ্যাচারিতে দ্রুত বর্ধনশীল পোনা সংগ্রহ করা ।
গ. ব্রুড ব্যাংক থেকে রুই জাতীয় ব্রুড মাছ সংগ্রহ করা ।
ঘ. এক হ্যাচারি থেকে অন্য হ্যাচারিতে ব্রুড আদান প্রদানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যেতে পারে ।
২। ব্রুড মাছ পালন :
ক.বাছাইকৃত ব্রুড ভালো পরিবেশে উৎপাদনশীল পুকুরে ২/৩ বছর যত্ন সহকারে পালন করতে হবে ।
খ. প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি বাহির থেকে ২০-২৫% প্রোটিনসমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে ।
গ. মজুদ ঘনত্ব সঠিক মাত্রায় রাখতে হবে এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হলে ভালো ।
ঘ. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে ।
কমন কার্পের প্রণোদিত প্রজনন :
পিটুইটারি গ্লান্ড ইনজেকশনের মাধ্যমে কমন কার্পের প্রণোদিত প্রজনন সম্পন্ন করা হয় । বাছাই করা ব্রুড মাছকে ৩-৪ মি.গ্রা./কেজি দেহ ওজনের জন্য পিজি ইনজেকশন করে পেট সেলাই করে দেওয়া হয় । পেট সেলাই করার জন্য মোম লাগানো সুতা ব্যবহার সুবিধাজনক । পেট সেলাই দেওয়ার সুবিধা হলো পরিপূর্ণ ওভুলেশন না হওয়া পর্যন্ত ডিম বের হওয়া বন্ধ থাকে । কমন কার্পের ইনজেকশন ও পেট সেলাই করার আগে মাছকে অবচেতন করে নেয়া হয়।
এজন্য এম এস ২২২ ঔষধ ০.৫ গ্রাম প্রতি ৫০ মি.লি. পানিতে গুলিয়ে একটি তুলার সাহায্যে মাছের মুখে দেওয়া হয়। একই সাথে পুরুষ মাছকে ২ মি.লি. গ্রাম/কেজি হিসেবে পিজি দ্রবণের ইনজেকশন দিয়ে পৃথক চৌবাচ্চায় রাখা হয় । ২৭-২৮° সে. তাপমাত্রায় ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে ওভুলেশন সম্পন্ন হয়। স্ট্রিপিং প্রক্রিয়ায় কমন কার্পের প্রজনন ঘটানো হয় । ইনজেকশন দেওয়ার ৬-৮ ঘণ্টার পর স্ত্রী মাছকে সাবধানে ধরে পেটের সেলাই কেটে দিতে হয় ।
শুকনা প্লাস্টিকের গামলায় চাপ প্রয়োগ করে ডিম বের করা হয় । সাথে সাথে পুরুষ মাছ সংগ্রহ করে ঐ ডিমের উপর শুক্র বা মিল্ট সংগ্রহ করা হয় । পরিষ্কার পাখির পালক দ্বারা ডিম ও শুক্রাণুকে ভালোভাবে নেড়ে মিশিয়ে দেওয়া হয় । অন্যন্যা কার্প জাতীয় মাছের ডিম থেকে কমন কার্প মাছের ডিমের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের ডিম আঠালো প্রকৃতির ।
তাই এদের ডিম একটার গায় একটা লেগে যায় বা অন্য কোনো বস্তুর গায়ে লেগে যায় বলে আলাদাভাবে যত্ন নেওয়া অবশ্যক । ডিমের এই আঠালো বৈশিষ্ট্যের দরুন স্ট্রিপিং-এর পর সংগৃহীত ডিমকে ইউরিয়া ও লবণ পানি দ্রবণে ধৌত করতে হয় ।
আঠালো ডিমের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া (যেমন-মিরর/কমন কার্পের ক্ষেত্রে) :
১. হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী মাছকে ব্রিডিং পুলে স্রোত ও ফোয়ারা সহকারে রাখতে হবে ।
২. পুরুষ মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর পৃথক ব্রিডিং পুলে স্রোত ও ফোয়ারা সহকারে স্ত্রী মাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে রাখতে হবে।
৩. ১০ লিটার পানিতে ৩০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৪০ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ তৈরি করে রাখতে হবে ।
৪. ডিম পাড়ার সঠিক সময়ে পুরুষ মাছ ধরে পেটে চাপ দিয়ে বীর্য পূর্বে সংগৃহীত ডিমের উপর ফেলে একটি পাখির পালক দিয়ে বীর্যকে ডিমের সঙ্গে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত করতে হবে । কিছু দ্রবণ ডিমের মধ্যে দিতে হবে এবং নাড়াতে হবে । এইভাবে ৫ মিনিট অন্তর অন্তর দ্রবণ ডিমের মধ্যে দিতে হবে এবং নাড়তে হবে। এই প্রক্রিয়া ৩০-৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকবে ।
৫. এই প্রক্রিয়ার ফলে ডিমের গায়ের প্রোটিন দূর হবে এবং ডিম নরম হয়ে যাবে। এরপর ডিমগুলোকে
ননীযুক্ত দুধ দিয়ে ২৫-৩০ মিনিট নাড়ার পর ডিম শক্ত ভাব ধারণ করবে ।
৬. এই ডিমকে তখন পরিমাপ করে হ্যাচিং জার অথবা ইনকুবেশন ট্যাংকে পানির স্রোত ও ফোয়ারার মধ্যে
স্ফুটনের জন্য রাখতে হবে ।
৭. জার অথবা পুলে ডিম দেওয়ার পর ডিমগুলো জার বা পুলের গায়ে আটকে যেতে থাকলে পাখির পালক
বাঁধা একটি কাঠি দিয়ে ডিমগুলোকে ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে দিতে হবে।
ডিম ফোটানো :
উপযুক্ত ব্রুড মাছ থেকে প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ১০০০০০-২০০০০০ টি ডিম পাওয়া যায় । নিষিক্ত ডিমের আঠালো ভাব দূর করার পর এদেরকে হ্যাচিং জার বা হ্যাচিং বোতলে দেওয়া হয় । অবশ্য ডিমের পরিমাণ বেশি হলে সার্কুলার ট্যাংক ইনকুবেশন ট্যাংক ও ব্যবহার করা যায় । প্রতিটি বোতলে ১-১.৫ কেজি পানিতে ফোলা ডিম ফুটানো যায়। কমন কার্পের ডিম ফুটতে বেশি সময় নেয়। যেখানে অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছের ডিম ফুটতে ১৬-২২ ঘণ্টা সময় লাগে সেখানে কমন কার্পের ডিম ফুটে বাচ্চা বের থেকে ৬০- ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে ।
আরও দেখুন: