আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় একটি আদর্শ পুকুরের বিভিন্ন অংশ ও তার কার্যাবলি – যা মাছচাষে পুকুরের ধরন ও পুকুর খনন এর অন্তর্ভুক্ত।
একটি আদর্শ পুকুরের বিভিন্ন অংশ ও তার কার্যাবলি
একটি আদর্শ পুকুরের জন্য নিম্নলিখিত অংশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
ক. পুকুরের পাড়
খ. বকচর
গ. চাল
ঘ. তলদেশ
ঙ. পানি নিষ্কাশন নালা
চ. পানি অনুপ্রবেশ নালা
ক. পুকুরের পাড় :
পাড়ের প্রধান কাজ হলো বাহির থেকে যাতে পুকুরের মধ্যে বিষাক্ত বা দূষিত পানি ঢুকতে না পারে তা রক্ষা করা এবং পুকুরকে বন্যা মুক্ত রাখা ।
খ. বকচর :
পুকুরের পাড়ের ঢালের ভিতরের দিকে, চালের শেষ প্রাপ্ত থেকে ফুল পুকুরের প্রাপ্ত পর্যন্ত ব্যবধানকে বকচর বলে। এর প্রধান কাজ হলো যাতে পুকুরের পাড় ও ঢাল ভেঙে না যেতে পারে।
গ. চাল :
ঢালের কাজ হলো পুকুরের পাড় যেন ভেঙে না পড়ে এবং সব স্থানে যাতে সমানভাবে আলো পড়তে পারে। এ ছাড়াও ঢাল প্রশস্ত হলে মাছ ধরতে সুবিধা হয় ।
ঘ. পুকুরের তলদেশ :
এটি পুকুরের সর্বনিম্ন স্তর। এ স্তরের প্রধান কাজ হলো পুকুরের পানি সংরক্ষণ করা যাতে অধিক পরিমাণ পানি চুইয়ে বের হয়ে না যেতে পারে। এ ছাড়া পুকুরের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য এ স্তরটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ঙ.পানি নিষ্কাশন নালা :
এর প্রধান কাজ হলো প্রতিকূল পরিবেশে অতিরিক্ত পানি বের করে দিয়ে মাছ চাষের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ নালাটি পুকুরের তলদেশের কাছাকাছি থাকে। পুকুরের পানি বের করে দিয়ে মাছ ধরার ক্ষেত্রেও এ নালাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ. পানি অনুপ্রবেশ নালা :
এ নালার প্রধান কাজ হলো প্রতিকূল পরিবেশে যাতে পরিষ্কার পানি ঢুকানো যায় । এ নালা পুকুরের সর্বোচ্চ পানির স্তরের উপরে থাকে।

পুকুর খনন পদ্ধতি :
বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ চাষের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পুকুর খনন তথা অদায়তন নির্ধারণ এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুকুর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে মাছ বাজারজাতকরণ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার প্রত্যেকটি ধাপ। তাই প্রত্যেক মৎস্য চাষির অবশ্যই এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে । নিচে কিভাবে মৎস্যচাষি এবং মৎস্য সেক্টরে জ্ঞানপিপাসু ছাত্র-ছাত্রী এ ব্যাপারে সহায়তা পেতে পারে তার এক দিক নির্দেশনা তথা পুকুর খননের মৌলিক নীতিসমূহ দেয়া হলো-
ক. মাটির উর্বরতা পরীক্ষা :
যে স্থানে পুকুর কাটা হবে ঐ স্থানে ৪-৫টি জায়গা থেকে অল্প কিছু পরিমাণ মাটি তুলে একটি কাঁচের পাত্রে পানির সাথে উত্তমরূপে মিশিয়ে নিতে হয়। অতঃপর গ্লাসটিকে একটি নিরাপদ স্থানে রেখে দিয়ে কিছু সময় পরে গ্লাসের তলদেশের বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট মাটির উপাদান দেখে স্থুল বালি কণার পরিমাণ, সুক্ষ্ম বালি কণার পরিমাণ, পলি কণার পরিমাণ ও জৈব পদার্থের পরিমাণ দেখে মাটির প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় । এছাড়াও নির্দিষ্ট জমির চারপাশের ফসল বা প্রাকৃতিক অবস্থা দেখেও মোটামুটিভাবে জমির উর্বরতা অনুমান করা যায় । কিন্তু খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে রাসায়নিক পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে।
খ. মাটির গঠন পরীক্ষা :
এ পরীক্ষার মুল উদ্দেশ্য হলো নির্ধারিত এলাকায় মাটির ধরন এবং পানি ধারণক্ষমতা জানা। মাটির পানি ধারণক্ষমতা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন-
১. মাটি স্পর্শ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে কিছু পরিমাণ মাটি হাতের আঙুলের মাথায় নিয়ে ঘর্ষণ দিলে যদি পিচ্ছিল ও মসৃণ মনে হয় তবে বুঝতে হবে এ মাটিতে প্রচুর পরিমাণ কর্দম কণা রয়েছে। যা পানি ধারণ করে রাখতে সক্ষম। যদি খসখসে মনে হয় তবে বুঝতে হবে এ মাটিতে প্রচুর পরিমাণে বালি রয়েছে এবং এ মাটির ধারণক্ষমতা নেই বললেই চলে।
২. হাতের তালু বা মুঠ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে মাটির পানি ধারণক্ষমতা পরীক্ষার জন্য হাতের তালুতে কিছু পরিমাণ ভেজা মাটি নিয়ে শক্ত করে হাত মুঠ করতে হবে এবং পরে খুলে ফেলতে হবে। হাতের মুঠোর মাটি যদি দলা বেঁধে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এ মাটি মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। কেননা এঁটেল মাটি দলা বাঁধতে পারে । অপর দিকে মাটি যদি দলা না বাঁধে তাহলে বুঝতে হবে মাটিতে বালির ভাগ বেশি, যা মাছ চাষের জন্য অনুপোযোগী ।
৩. মাটির বল তৈরি পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে খানিক মাটি হাতে নিয়ে সামান্য পানি দিয়ে ভিজিয়ে হাতের তালুর সাহায্যে মাটি দিয়ে একটি বল তৈরি করতে হবে। এবারে বলটিকে উপরের দিকে (১ থেকে ১.৫ মিটার) ছুড়ে দিয়ে হাতের তালুতেই আবার ধরতে হবে। মাটির বলটি যদি ভেঙে না যায় এবং পূর্বের আকারেই থাকে তবে বুঝতে হবে মাটি এঁটেল প্রকৃতির। আর যদি বলটি ভেঙে যায় তবে বুঝতে হবে মাটিতে বালির ভাগ বেশি ।

৪. কূপ খনন পদ্ধতি :
অনেক সময় নির্ধারিত স্থানের উপরের মাটির স্তর এঁটেল থাকা সত্ত্বেও তলদেশের মাটি বেলে হতে পারে । এ কারণেই পুকুর কাটার পূর্বে যে স্থানে পুকুর কাটা হবে সেখানকার ৫/৬ স্থানে প্রয়োজনীয় গভীরতায় কুয়া কাটতে হয়। এবার কুয়াগুলোকে পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। কুয়ার পানি যদি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বা দুই-এক দিনের মধ্যেই কমে যায়, তবে বুঝতে হবে পুকুরের তলদেশের মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম এবং ৭/৮ দিনেও যদি পানি না কমে তাহলে বুঝতে হবে মাটির ধারণক্ষমতা ভালো এবং মাছ চাষের জন্য উক্ত স্থানে পুকুর খনন করা যেতে পারে।
আরও দেখুন: