আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষে পোনা মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা।
রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষে পোনা মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা
পোনা মজুদের পূর্বে যেসব ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করা হয় তাকে মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা বলে । এক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-নীতি ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হবে তা হলো-
ক. মাছচাষ পরিকল্পনা;
খ. স্থান নির্বাচন;
গ. পুকুরের আকার, আয়তন এবং গভীরতা নির্ণয় করা;
ঘ. জলজ আগাছা দমন;
ঙ. রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা ;
চ. চুন প্রয়োগ;
ছ. মজুদপূর্ব সার প্রয়োগ;
জ. পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করা ও ঝ. প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা ।
ক. মাছচাষ পরিকল্পনা :
মাছ চাষের শুরুতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো মাছচাষের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। মৌসুমী না বাৎসরিক পুকুরে মাছচাষ করা হবে, আধা নিবিড় না নিবিড় পদ্ধতিতে মাছচাষ করা হবে, পাঙ্গাশ না কার্পজাতীয় মাছচাষ করা হবে, মজুদকৃত মাছের জন্য খাদ্যের উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক খাদ্য না পিলেটজাতীয় খাদ্যের ওপর নির্ভর করা হবে ইত্যাদি বিষয়ে অবশ্যই আগে থেকেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
এখন সামর্থ্য অনুযায়ী কোন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে এবং সেই ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরিচালনা করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে সেটা অবশ্যই জেনে নিয়ে সেই আঙ্গিকে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়ে মাছচাষ শুরু করতে হবে। কথায় বলে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অর্থ সংশ্লিষ্ট কাজের অর্ধেক সম্পন্ন করা। তাই মাছচাষ শুরুর পূর্বেই সঠিকভাবে মাছচাষ পরিকল্পনা করা । এর পরে মাছচাষের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হবে।
খ. স্থান নির্বাচন :
যদি খামারভিত্তিক মাছচাষ শুরু করতে হয় তাহলে অবশ্যই মাছচাষে পুজি বিনিয়োগের পূর্বেই যে অঞ্চলে খামার স্থাপন করা হবে সেই অঞ্চল মাছচাষের জন্য কতটুকু উপযোগী তা জেনে নিয়ে পরে খামারের জন্য স্থান নির্বাচন করতে হবে।
অনেক সময় একটি পুকুর কারিগরি দিক থেকে খুব ভালো মনে হলেও আর্থ-সামাজিক দিকগুলো অনুকূলে না থাকার ফলে মাছচাষ কার্যক্রম ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কারিগরি, আর্থ-সামাজিক, বাজারজাতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়সমূহকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। লাভজনকভাবে মাছচাষ করতে হলে স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

- দোঁ-আশ, কাদাযুক্ত দোঁ-আশ, পলিযুক্ত কাদা এবং এঁটেল মাটির পুকুর মাছচাষের জন্য উত্তম। এ ধরনের মাটিতে পুকুর খনন করলে প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি তৈরি হয়। ফলে মাছের উৎপাদনও অনেক বেড়ে যায়;
- পুকুরটি অবশ্যই বন্যামুক্ত হতে হবে;
- পুকুরের তলায় কাদার পরিমাণ কম হলে সবচেয়ে ভালো। তলায় কাদার পরিমাণ কোনোক্রমেই ৬ ইঞ্চি এর বেশি হওয়া উচিত নয়;
- পুকুরটি যেন খোলামেলা হয়। অর্থাৎ পুকুরটিতে যেন পর্যাপ্ত আলো বাতাস লাগে। পুকুর পাড়ে কোনো ছায়া প্রদানকারী বা নির্দিষ্ট ঋতুতে পাতা ঝরে যায় এমন গাছপালা না থাকাই ভালো । পুকুরে প্রত্যেক দিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পড়া উচিত;
- মাটির ধরন অনুযায়ী (এঁটেল ১ঃ১ এবং দোঁ-আশ ১ঃ২) পুকুর পাড়ের ঢাল হলে ভালো হয়;
- পাড়ের পরে কমপক্ষে ৫ ফুট বকচর থাকলে ভালো হয়;
- মাছচাষে ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় উপকরণসমূহ (চুন, সার, মাছের খাদ্য, ঔষধ প্রভৃতি) যেন অতি সহজে পাওয়া যায়;
- চাষকৃত মাছের পোনা সহজে এবং সুলভ মূল্যে সারা বছরই যেন পাওয়া যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া;
- পুকুরের মালিকানা একক এবং নিজস্ব হলে সবচেয়ে ভালো। ইজারা পুকুর হলে তা দীর্ঘমেয়াদি- কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে;
- পুকুর বসতবাড়ির কাছাকাছি হলে সবচেয়ে ভালো। এতে পুকুরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার সুবিধা হয়,
- মাছ চুরির ভয় থাকে না; বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষের নিমিত্তে পুকুরের পাশে বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়,
- পরিশেষে উৎপাদন সামগ্রী পুকুর পাশে আনা এবং উৎপাদিত মাছ দ্রুত বাজারজাতকরণের জন্য ভালো রাস্তাঘাট থাকা একান্ত প্রয়োজন ।
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি মাছচাষের জন্য অনুকূল তাই উক্ত স্থানকে মাছচাষের ক্ষেত্রে খামার বা পুকুরের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে । স্থান নির্বাচনের পরে পুকুরের আকার, আয়তন এবং গভীরতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হবে।
গ. পুকুরের আকার, আয়তন এবং গভীরতা নির্ণয় করা :
মাছচাষ ব্যবস্থাপনার ধরন অনুযায়ী পুকুর যেকোনো আকার এবং আয়তনের হতে পারে। তবে ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মজুদ পুকুরের আয়তন ১ একর এবং তা আয়তাকার উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি হলে বছরের যেকোনো ঋতুতে পুকুরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস লাগবে ফলে পুকুরের পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হবে যা পানিতে অক্সিজেন মেশাতে সহায়তা করবে।
মাছচাষ কার্যক্রমের ধরন অনুযায়ী পুকুরের পানির গভীরতা হলে সবচেয়ে ভালো হয়। যেমন- মজুদ পুকুরের জন্য ৬ ফুট এবং নার্সারি বা আঁতুড় পুকুরের জন্য ৩ ফুট গভীরতা হলো আদর্শ গভীরতা। পুকুরের আকার, আয়তন এবং গভীরতা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের পরে পুকুর প্রস্তুতির সঠিক নিয়মাবলি অনুসরণ করতে করতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতি :
মাছচাষের পুকুরে আশানুরূপ উৎপাদনের জন্য শুরুতেই পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে। পুকুর প্রস্তুত করার মূল উদ্দেশ্য হলো মাছের জন্য নিরাপদ আবাস, উপযুক্ত পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা। এক এক ধরনের পুকুরের জন্য এক এক ধরনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যেমন-
নতুন পুকুর
- বৃষ্টিতে পাড় ভেঙে পানি যেন ঘোলা না হয় সে জন্য পুকুরের নতুন পাড়ে দূর্বা জাতীয় ঘাস লাগানো,
- মাটি কাটার পরে তলার মাটিকে আলগা করার জন্য তলায় হালচাষ দেয়া;
- এঁটেল মাটির পুকুরে ঘোলাত্ব প্রতিরোধকল্পে ১০ কেজি/শতাংশ হারে ছাই প্রয়োগ করে সামান্য পানি দিয়ে হালচাষ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে।
পুরাতন পুকুর
- পুকুর পুরাতন হলে কোনো কোনো সময় অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন-
- পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করা;
- তলায় অতিরিক্ত (র্ড এর বেশি) পচা কাদা থাকলে তা তুলে ফেলা;
- পুকুর পাড়ে ছায়া প্রদানকারী গাছের বড় ডালপালা থাকলে তা ছেঁটে ফেলা;
- মৎস্যভূক (রাক্ষুসে) ও অবাঞ্ছিত মাছ থাকলে তা দূর করা ও
- জলজ আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করা ।
ঘ. জলজ আগাছা দমন :
পুকুরের পানিতে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাছের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদেরকে জলজ আগাছা বলে । পুকুরে কোনোক্রমেই জলজ আগাছা রাখা যাবে না কারণ এরা মাটি ও পানি থেকে পুষ্টিকর পদার্থ গ্রহণ করে যা প্ল্যাংকটনের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তারের জন্য একান্ত প্রয়োজন।
পুষ্টিকর পদার্থের অভাবে প্ল্যাংকটন এবং সেই সাথে মাছেরও উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জলজ আগাছা মাছের চলাচল এবং পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে ফলে সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয় তথা প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। কোনো কোনো সময় আগাছা মাছের রোগজীবাণুর আশ্রয়স্থল বা বাহক হিসেবেও কাজ করে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাসমান আগাছা পুকুরের পানিতে থাকলে বাতাস পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি করতে পারে না ফলে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ কম হয় । কাজেই মাছচাষের পুকুরে জলজ আগাছা রাখা যাবে না ।
ঙ. রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ :
জলজ আগাছা দমনের পরে পুকুর থেকে অবশ্যই মৎস্যভূক ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করতে হবে। রাক্ষুসে এবং অবাঞ্ছিত মাছ আমরা দুইভাবে দূর করতে পারি। যেমন-
পানি শুকিয়ে :
বিভিন্ন ধরণের পাম্প মেশিন দ্বারা পুকুর শুকানো যেতে পারে । পুকুর শুকানোর পরে তলায় যদি ৬ ইঞ্চির বেশি পচা কাদা থাকে তাহলে অতিরিক্ত পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে। আর কোনো ক্রমেই যদি পুকুর শুকানো সম্ভব না হয় তাহলে বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ তুলে ফেলতে হবে। এর পরেও যদি ক্ষতিকারক মাছ থেকে যায় বলে সন্দেহ হয় তাহলে বাজারের সহজলভ্যতা অনুসারে অনুমোদিত মাত্রায় মাছ মারার ঔষধ (বিষ) প্রয়োগ করতে হবে।
ঔষধ (বিষ) প্রয়োগ করে :
নিচে মাছ মারার বিভিন্ন ঔষুধের (বিষ) নাম এবং প্রয়োগমাত্রা দেয়া হলো ।
সুবিধামতো ঔষধটি বেছে নিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে মৎস্যভুক (রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণে রোটেনন পাউডার সবচেয়ে ভাল ঔষধ কারণ এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং এর দ্বারা মৃত মাছ খাওয়া যেতে পারে যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। এ রোটেনন পাউডার ডেরিস নামক গাছের শিকড় থেকে তৈরি করা হয়।
চ. চুন প্রয়োগ :
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণের পরে পুকুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানি চাষযোগ্য রাখতে, মাছের বসবাসের জন্য পরিবেশ উপযোগী রাখতে, মাছকে রোগমুক্ত রাখতে মাছচাষের পুকুরে অবশ্যই নিয়মিতভাবে চুন বা চুন সদৃশ উপকরণ প্রয়োগ করতে হয়।
আরও দেখুন: