মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ – যা মাছচাষে প্রতিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব এর অন্তর্ভুক্ত।

মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ

মাছচাষে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিবেশের এমন রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ হলো –

ক. দ্রবীভূত অক্সিজেন
খ. দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড
গ. পিএইচ
ঘ. মোট ক্ষারত্ব
ঙ. মোট খরতা
চ. খরতা
ছ. নাইট্রোজেন
জ. অ্যামোনিয়া
ঝ. হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি ।

ক. দ্রবীভূত অক্সিজেন :

অন্যান্য জীবের ন্যায় জীবন ধারণের নিমিত্ত মাছের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো অক্সিজেন । তবে অধিকাংশ মাছ (ব্যতিক্রম কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি) মানুষের ন্যায় বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না বিধায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনই তাদের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং তাপমাত্রা মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণিদের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের জন্য পানিতে বিভিন্ন মাত্রায় দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। তবে সব প্রজাতির জন্য গড়ে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৫ মিলিগ্রাম/লিটার হলে মাছের জন্য সবচেয়ে ভাল। পানিতে এ অক্সিজেনের মাত্রা ২ মিলিগ্রাম/লিটারের কম হলে কার্পজাতীয় মাছের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যহত হয়। অক্সিজেনের মাত্রা উল্লেখিত মানের চেয়ে কম হলে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রম কমে যায় । ফলে মাছ কম খাদ্য গ্রহণ করে এবং মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যায়।

খ. দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড :

মাছের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের পাশাপাশি দ্রবীভূত কার্বন ডাই- অক্সাইডও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন ডাই-অক্সাইড সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস পেলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হয়। আবার মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে গেলে পানির অম্লত্ব বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রচুর প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হলেও পানির অম্লত্বের কারণে মাছের খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা ও চাহিদা হ্রাস পায়। পানিতে ২ মিলিগ্রাম/লিটার মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মাছচাষের জন্য সবচেয়ে ভালো ।

গ. পিএইচ (PH) মান :

পানির অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের পরিমাপকই হচ্ছে পিএইচ। পিএইচ ৭ এর কম হলে সে পানি অম্লীয়, ৭ এর বেশি হলে সে পানি ক্ষারীয় এবং পিএইচ ৭ হলো নিরপেক্ষ পিএইচ। মাছচাষের ক্ষেত্রে এ পিএইচ মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পিএইচ মান ৯.৫ এর বেশি হলে সে পানিতে মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকতে পারে না বিধায় সালোকসংশ্লেষণ ব্যহত হয় এবং পানিতে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় মাছের উৎপাদন মারাত্বকভাবে ব্যহত হয়। আবার পিএইচ মান যদি ৪ এর নিচে নেমে আসে তাহলেও মাছ মারা যেতে পারে। কারণ এ অবস্থায় মাছের ক্ষুধা হ্রাস পায়, বৃদ্ধি কমে যায়। পিএইচ মান ৭.০-৭.৫ এর মধ্যে থাকলে ফসফরাস সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত মাছচাষের জন্য মৃদু ক্ষারীয় পানি (পিএইচ ৭.৫- ৮.৫) সবচেয়ে ভালো। পিএইচ মান অনুকূল অবস্থায় বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন অনুসারে মাঝে মাঝে চুন অথবা জিয়োলাইট প্রয়োগ করা দরকার ।

ঘ. মোট ক্ষারত্ব (Total Alkalinity) :

পানির মোট ক্ষারত্ব ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়ামের কার্বোনেট বা বাই-কার্বোনেট হিসেবে পরিমাপ করা হয়। পুকুরের উৎপাদন ক্ষমতা মোট ক্ষারত্বের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। পানিতে মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ বেশি হলে বা অনুকূলে হলে পিএইচ খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে না, যা মাছচাষের জন্য ভালো। মাছচাষের জন্য পানির মোট ক্ষারত্বের কাঙ্ক্ষিত মাত্রার পরিমাণ হলো ৭০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার। পুকুরের পানিতে মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ কমে গেলে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করে এ মাত্রা বাড়ানো যায় ।

ঙ. মোট খরতা (Total Hardness) :

সাধারণত খরতা হলো ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আয়নের পরিমাপক । যা প্রকাশ করা হয় ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে। মোট খরতার পরিমাণ মোট ক্ষারত্বের সাথে সম্পর্কিত। পানির খরতা ২০ মিলিগ্রাম/লিটারের কম হলে পানির বাফার ক্রিয়া (Buffer action) নষ্ট হয়ে যায় এবং মাছের জন্য তা বিশেষভাবে ক্ষতিকর।

ভালো জলাশয়ের খরতা ৪০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার এর মধ্যে হওয়া উচিত। পুকুরের পানিতে মোট খরতার পরিমাণ কমে গেলে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করে এ মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। তবে মোট ক্ষারত্বকে অপরিবর্তিত রেখে মোট খরতা বাড়াতে চাইলে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে জিপসাম ব্যবহার করা যেতে পারে।

চ. খরতা (Hardness) :

এর দ্বারা পানিতে দ্রবীভূত ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম লবণসমূহের মাত্রা বুঝা যায়। মাছচাষের জন্য ব্যবহৃত জলাশয়ের খরতা ৮০-১০০ মিলিগ্রাম/লিটার -এর মধ্যে হওয়া উচিত। খরতা কম হলে মাছ মারা যায় না তবে তা রোগ সৃষ্টিতে সহায়ক।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ছ. নাইট্রোজেন :

নাইট্রোজেন উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের মৌল পুষ্টি উপাদান। আমিষ সংশ্লেষণের উপকরণ হিসেবে নাইট্রোজেন জলজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। নাইট্রোজেন উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন কে ঘন সবুজ রাখতে সহায়তা করে। পরিমিত নাইট্রোজেনের উপস্থিতিতে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়, তথা বৃদ্ধি বা সংখ্যাধিক্য ত্বরান্বিত হয়, যা মাছচাষের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। পানিতে ০.২ মিলিগ্রাম/লিটার (মাটিতে ৮-১০ মিলিগ্রাম/ ১০০ গ্রাম মাটি) নাইট্রোজেন মাছ চাষের জন্য খুবই উপযোগী ।

প্রাকৃতিক পানিতে নাইট্রোজেন সাধারণত পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না বিধায় মাটিতে বা • পানিতে নাইট্রোজেনের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। পানির স্বচ্ছতা ৩০ সেন্টিমিটার বা ১ ফুটের বেশি হলে সাধারণত প্রতি একর পুকুরে ২০ কেজি হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।

জ. অ্যামোনিয়া :

মাছচাষে ক্ষতিকর যেসব গ্যাস রয়েছে তার মধ্যে অ্যামোনিয়া অন্যতম। অবিয়োজিত অ্যামোনিয়া (NH3) মাছের জন্য বিষাক্ত কিন্তু অ্যামোনিয়াম আয়ন (NH) বিষাক্ত নয়। পানিতে যদি দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় তাহলে অবিয়োজিত অ্যামোনিয়ার বিষাক্ততা বেড়ে যায় । পানিতে অবিয়োজিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.০২৫ মিলিগ্রাম/লিটার হলে তা মাছ চাষের জন্য ভাল। কিন্তু 0.8 মিলিগ্রাম/লিটার এর বেশি হলে সাধারণত মাছ মারা যায়। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি হলে অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে তা কমানো যায়। বর্তমানে অ্যামোনিয়া দূরীকরণে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহৃত হয় ।

ঝ. হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) :

অবিয়োজিত হাইড্রোজেন সালফাইড মাছের জন্য খুবই বিষাক্ত । পানির তলদেশে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জৈব পদার্থের পচনের ফলে হাইড্রোজেন সালফাইড উৎপন্ন হয়। পঁচা ডিমের ন্যায় গন্ধ দ্বারা এ গ্যাসের উপস্থিতি অতি সহজেই বুঝা যায়। পুকুরের পানির জন্য হাইড্রোজেন সালফাইডের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা হলো ০.০০৩ মিলিগ্রাম/লিটারের কম। কোনো কারণে পুকুরে এ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে পুকুরের তলদেশে হড়রা টেনে এ গ্যাস দূর করা যায় ।

মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী মাটি ও পানির বিভিন্ন গুণাগুণের নাম, অনুকূল মাত্রা এবং সমাধানে করণীয় একটি জলাশয়ের উৎপাদন ক্ষমতা তার মাটি ও পানির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে। মাছচাষে ভালো ফল পেতে হলে পুকুরের মাটি ও পানির গুণাবলি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। মাছ পানিতে বসবাস করে এবং পানি থেকেই জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।

আবার মাটি হচ্ছে পানি সংরক্ষণের আধার অর্থাৎ পানির খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা সরাসরি মাটির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে লাভজনকভাবে মাছচাষ করতে হলে মাটি ও পানির বিভিন্ন গুণাগুণের অনুকূল মাত্ৰা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। নিচে মাছচাষের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে এমন পুকুরের মাটি ও পানির গুণাগুণের নাম এবং অনুকূল মাত্রা দেয়া হলো-

 

মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ

 

মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ

 

মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী রাসায়নিক নিয়ামকসমূহ

আরও দেখুন:

Leave a Comment