আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছ বাজারজাতকরণ পদ্ধতি – যা মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ এর অন্তর্ভুক্ত।
মাছ বাজারজাতকরণ পদ্ধতি
আমাদের দেশে স্বল্প এবং দীর্ঘ সময়ে মাছ বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- স্বল্প দূরত্বে মাছ বাজারজাতকরণের সময়ে মাছ সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ ছাড়াই পুকুর, নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদি হতে যে অবস্থায় মাছ আহরণ করা হয় ঠিক সে অবস্থায় বাজারে নিয়ে আসা হয় ।
আবার মাছ যদি ধৃত স্থান হতে অনেক দূরে বাজারজাত করতে হয় তাহলে অধিকাংশ মৎস্য চাষি বরফ দ্বারা মাছের ঝুড়িতে করে মাছ বাজারজাতকরণ করে থাকে। বরফ দ্বারা মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক সময় মাছ ও বরফের সঠিক অনুপাত মানা হয় না বলে মাছের গুণগতমানের অবনতি ঘটে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে, সঠিক অনুপাতে (গ্রীষ্মকালে মাছ ও বরফের অনুপাত ১ঃ১ এবং শীতকালে মাছ ও বরফের অনুপাত ২ঃ১) বরফে সংরক্ষণ করে মাছ বাজারজাতকরণ করলে মাছের ভাল বাজার মূল্য পাওয়া যেতে পারে।
মাছ বাজারজাতকরণের সমস্যা ও সমাধান : আমাদের দেশে মাছ বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয় সেগুলো এবং কীভাবে সেসব সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে তার দিক নির্দেশনা নিচে দেয়া হলো ।
সমস্যাসমূহ
১. প্রয়োজনীয় অবতরণ কেন্দ্রের অভাব :
আমাদের দেশে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলো সাধারণত মাছ ধরার স্থান থেকে অনেক দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত । ফলে ধৃত মাছ অবতরণ কেন্দ্রে আনতে অনেক সময় লাগে । এই সময়ের মধ্যে মাছের গুণগতমান অনেক কমে যায়। ফলে মৎস্যজীবীরা মাছের কম মূল্য পেয়ে থাকে ।
২. মৎস্য বাজারে প্রয়োজনীয় স্থানের অভাব :
অধিকাংশ মৎস্য বাজার সমূহে যানবাহন প্রবেশের স্থানের অভাবে মাছ মাথায় করে কিংবা ঠেলাগাড়িতে করে বিক্রির জন্য বাজারে নিতে হয় । এতে করে মাছের ওপর চাপ পড়ে আবার অনেক সময় রোদ বৃষ্টি হতে মাছকে রক্ষা করার জন্য মাছ বাজারে কোন ছাউনির ব্যবস্থা নেই ৷ ফলে রোদ-বৃষ্টিতে মাছের গুণগতমানের যথেষ্ট অবনতি ঘটে ।
৩. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব :
আমাদের দেশে অধিকাংশ মাছ বাজারের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মাছ ধরা হয় সেখান থেকে মাছ বাজারে আনতে বেশির ভাগ মাছের গুণগতমান হ্রাস পায় ৷
৪. বরফ প্রাপ্তির অভাব :
সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর, পাবনা ইত্যাদি জেলার অর্ন্তগত বিল ও হাওড় এলাকায় এবং উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল, যেমন- সেন্টমার্টিনস্, কুতুবদিয়া ও দুবলার চর এলাকায় বরফের অভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে উল্লেখিত উপকূলীয় এলাকায় বরফের অভাবে মোট আহরিত মাছের ৪০% শুঁটকি করে বাজারজাত করে থাকে ।

৫. অপর্যাপ্ত বরফ ব্যবহার :
বরফ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রায়শই সঠিক অনুপাত মেনে চলা হয় না । আমাদের দেশে শীতকালে বরফ ও মাছের অনুপাত ১ : ২ এবং গ্রীষ্মকালীন ১ : ১ হওয়া উচিত। কিন্তু মৎস্যজীবীরা এর চেয়ে অনেক কম পরিমাণে বরফ ব্যবহার করে থাকে বলে মাছের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায় ।
৬. ইনসুলেশনের অভাব :
অনেক মাছ সংগ্রহকারী যান্ত্রিক নৌকায় ইনসুলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে প্রচুর পরিমাণে বরফ নষ্ট হয়ে যায়। এসব মাছ সংগ্রহকারী নৌকায় হোগলা পাতা, কাঠের গুঁড়া, তুষ ইত্যাদি ব্যবহার করে বরফের সংরক্ষণ দীর্ঘায়িত করা যায় ।
৭. পর্যাপ্ত প্যাকেজিং সুবিধাদির অভাব :
মাছ পরিবহনের জন্য যেসব বাক্স ব্যবহৃত হয় সেগুলো সাধারণত খুবই বড় হয়। এগুলোতে বেশি পরিমাণ মাছ ভর্তি করা হয়। ফলে উপরের মাছের চাপে নিচের মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাক্সগুলোতে অতিরিক্ত মাছ (৮ মণ পর্যন্ত) রাখার ফলে মাছ ওঠানামা করতে খুবই অসুবিধা হয়। বিদেশে রপ্তানি কাজে ব্যবহৃত দেশে তৈরি কার্টনগুলোতে ভালো কাগজ ও মোম ব্যবহার করা হয় না বলে সহজেই মাছ নষ্ট হয়ে যায় ।
৮. স্বাস্থ্য বিধি মানা হয় না :
আমাদের দেশে মৎস্য বিপণনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধির ওপর কম গুরুত্ব দেয়া হয় । প্রায়শই মাছ রাখার পাত্র এবং বাক্স পরিষ্কার বা ধৌতকরণ করা হয় না। অধিকংাশ খুচরা বাজারের মেঝে সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় না।
৯. মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব :
মৎস্যজীবী কর্তৃক মাছ ধরার পর ধৃত মাছগুলো সরাসরি ক্রেতার নিকট পৌঁছায় না বরং বিপণন মাধ্যমের নিকারী, চালানী, আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতার হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছায় । এভাবে প্রতিবার হাত বদলের ফলে একদিকে মাছের গুণগত মানের অবনতি ঘটে অন্যদিকে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের লাভবান হবার কারণে মৎস্যজীবীরা ও ক্রেতাসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
সমাধান
১. দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মৎস্য অবতরন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে ।
২. মৎস্য বাজারগুলোতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভূমি থেকে কমপক্ষে ২ ফুট উঁচু ভিটিসহ পাকা টিনের চালা ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. মৎস্য বাজারের সঙ্গে স্থল অথবা নৌ-পথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয় ।
৪. প্রয়োজনীয় সংখ্যক বরফ কল স্থাপন করতে হবে এবং বিদ্যুতের অভাবে যেন বরফ কল বন্ধ হয়ে না যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণকালে সঠিক অনুপাতে বরফ ব্যবহার করতে হবে।
৬. বরফায়িত বা হিমায়িত মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে রেফ্রিজারেটেড ও ইনসুলেটেড ভ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি কাজে সঠিক মানের প্যাকেজিং দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
৮. মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে নিয়োজিত কর্মীকে স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন হলে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৯. মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করতে হবে।
আরও দেখুনঃ