মাছ চাষে করণীয় : মাছ আমাদের আমিষ জোগানের প্রধান উৎস। বাজার থেকে মাছ কিনে খাওয়ার চেয়ে নিজের পুকুরে জলাশয়ে মাছ চাষ করে নিজেরা খাওয়া যায়। অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। তবে মাছ চাষে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক বা আধুনিক প্রযুক্তি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত যত্নআত্তি করলে মাছ চাষে লাভাবান হওয়া যায়। শীতকাল মাছ চাষে অতিরিক্ত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটু সচেতন হলেই সেসব সমস্যা সমাধান করা যায় অনায়াসে। আমাদের দেশে শীতকালে মাছের বিশেষ কিছু কিছু রোগ দেখা যায়।
মাছ চাষে করণীয়
এ সময় সঠিকভাবে মাছের যত্ন না নিলে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যেতে পারে। শীতকালে মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, ফুলকা পচা রোগ এবং উদর ফোলা রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করলে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়। শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন। কারণ এ সময়ে পুকুরের পানি কমে যায়, পানি দূষিত হয়, মাছের রোগবালাই হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করলে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
মাছের ক্ষতরোগ :
এফানোমাইসেস ছত্রাকপড়ে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছে এ রোগ হয়। যেমন- টাকি, শোল, পুঁটি, বাইন, কই, শিং, মৃগেল, কাতলসহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছে এ রোগ হয়। মাছের ক্ষত রোগ হলে প্রথমে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যায়। লাল দাগে ঘা ও ক্ষত হয়। ক্ষতে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়। লেজের অংশ খসে পড়ে। মাছের চোখ নষ্ট হতে পারে। মাছ ভারসাম্যহীনভাবে পানির ওপরে ভেসে থাকে। মাছ খাদ্য খায় না। আক্রান্ত মাছ ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মারা যায়।
এ রোগে করণীয় হলো শীতের শুরুতে ১৫ থেকে ২০ দিন পরপর পুকুরে প্রতি শতাংশে ০১ কেজি ডলোচুন ও ০১ কেজি লবণ মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুর আগাছামুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। জৈবসার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জলাশয়ের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। মাছের ঘনত্ব কম রাখতে হবে। ক্ষতরোগ হওয়ার আগে এসব ব্যবস্থা নিতে হবে। মাছ ক্ষতরোগে আক্রান্ত হলে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৬০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন ওষুধ দিতে হবে। অথবা তুঁত দ্রবণে মাছ ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছাড়তে হবে। আক্রান্ত মাছপুকুর থেকে সরাতে হবে।
লেজ ও পাখনা পচা রোগ :
অ্যারোমোনাসে ওমিক্সো ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ রোগ হয়। কার্প ও ক্যাটফিস জাতীয় মাছে বেশি হয়। তবে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ প্রায় সব মাছেই এ রোগ হতে পারে। রোগের লক্ষণ হলো মাছের পাখনা ও লেজের মাথায় সাদা সাদা দাগ পড়ে। লেজ ও পাখনা পচে খসে পড়ে। দেহের পিচ্ছিলতা কমে যায়। দেহের ভারসাম্য হারায় এবং ঝাঁকুনি দিয়ে পানিতে চলাচল করে।
মাছ ফ্যাকাশে হয়। মাছ খাদ্য কম খায়। আক্রান্ত বেশি হলে মাছ মারা যায়। রোগ প্রতিরোধ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। রোগ হওয়ার আগেই ওই ব্যবস্থাগুলো নিলে লেজ ও পাখনা পচা রোগ হয় না। আক্রান্ত পাখনা কেটে মাছকে শতকরা ২.৫ ভাগ লবণে ধুয়ে নিতে হবে। এক লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম তুঁত মিশিয়ে ওই দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে এক মিনিট ডুবিয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে। মাছের পরিমাণ কমাতে হবে। আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে সরাতে হবে।
ফুলকা পচা রোগ :
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে অধিকাংশ বড় মাছে এ রোগ হয়। তবে সব প্রজাতির পোনা মাছেই এ রোগ হতে পারে। লক্ষণ হলো মাছের ফুলকা পচে যায় এবং আক্রান্ত অংশ খসে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। মাছ পানির ওপর ভেসে ওঠে। মাছের ফুলকা ফুলে যায়। ফুলকা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আক্রান্ত মারাত্মক হলে মাছ মারা যায়। এ রোগ হলে করণীয় হচ্ছে শতকরা ২.৫ ভাগ লবণে আক্রান্ত মাছকে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়তে হবে। এক লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম তুঁত মিশিয়ে ওই দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে এক মিনিট ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছাড়তে হবে।
উদর ফোলা বা শোঁথ রোগ
: অ্যারোমোনাস নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে কার্পও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি রোগ বেশি হয়। এ রোগ সাধারণত বড় মাছে বেশি হয়। লক্ষণ হলো দেহের ভেতর হলুদ বা সবুজ তরল পদার্থ জমা হয়। পেট খুব বেশি ফুলে। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তরল পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। মাছ উল্টা হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। দেহে পিচ্ছিল পদার্থ কমে যায়। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়। প্রতিকার হলো- আঙুল দিয়ে পেটে চাপ দিয়ে কিংবা সিরিঞ্জ দিয়ে তরল পদার্থ বের করতে হবে। প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পরপর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। অন্যান্য পরিচর্যা-১. পানির অক্সিজেন বৃদ্ধির জন্য বাঁশ দিয়ে অথবা সাঁতার কেটে অথবা পানি নাড়াচাড়া করতে হবে।
একরপ্রতি ০৫ থেকে ১০ কেজি টিএসপি দিলেও হবে। ২. পুকুরের পানিতে সরাসরি রোদ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে পুকুরের পানি গরম হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। ৩. শেওলা, আবর্জনা, কচুরিপানা, আগাছাসহ সব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করতে হবে। ৪. ১৫ দিন পরপর জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। ৫. পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস হলে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ৬. পানি ঘোলা হলে ১ মিটার গভীরতায় ১ শতক পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ৭. পুকুরের পানি কমে গেলে পানি সরবরাহ করতে হবে।
৮. পুকুরের পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করতে হবে। ৯. সুষম খাদ্য নিয়মিত সরবরাহ করতে হবে। শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নিতে হয়। কারণ এ সময়ে পুকুরে পানি কমে, পানি দূষিত হয়, পানি গরম হয়, অক্সিজেন কমে যায়, গ্যাস সৃষ্টি হয়, রোগবালাইসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যার জন্য মাছের মড়ক দেখা দিতে পারে। এতে মাছ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমস্যার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে ও সমস্যা হওয়ার পরেও সমাধান করে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
খাবি খাওয়া :
পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে মাছ পানির ওপর ভেসে ওঠে খাবি খায়। অর্থাৎ বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের চেষ্টা করে। মনে হয় মাছ পানি খাচ্ছে। মাছ খুব ক্লান্ত হয়। এতে মাছের ফলন কমে। পানিতে সাঁতারকাটা, বাঁশ পানির ওপর পেটানো, হররা টেনে তলার গ্যাস বের করে দেয়া, পুকুরে পাম্প বসিয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করা, পানি নাড়াচাড়া করে অক্সিজেন বাড়ানো যায়। নতুন পানি সরবরাহ করেও অক্সিজেন বাড়ানো যায়। প্রতি শতাংশে এক কেজি চুন দিলে উপকার পাওয়া যায়।
কার্বন-ডাই-অক্সাইডজনিত পানি দূষণ :
পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে মাছের দেহে বিষক্রিয়া হয় এবং শ্বাসকষ্ট হয়। মাছ পানিতে ভেসে ওঠে। খাবি খাওয়া প্রতিকারের মতো পানি নাড়াচাড়া করে অক্সিজেন বাড়ালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে যায়। পুকুর তৈরির সময় অতিরিক্ত কাদা সরাতে হবে।
অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যা :
পুকুরে অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে পানির রঙ তামাটে অথবা কালচে রঙের হয়। এতে মাছের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। মাছ খাদ্য খায় না। বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাছের মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে। সার ও খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে।
নাইট্রোজেনজনিত সমস্যা :
পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছের দেহে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। এতে মাছের দেহ বাদামি রঙ ধারণ করে। মাছ খাদ্যগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমাতে হবে। পুকুরে ২৫০ মিলিগ্রাম লবণ প্রতি লিটার হারে দিতে হবে।
পিএইচজনিত সমস্যা :
পানিতে পিএইচ কমে গেলে মাছের দেহ থেকে প্রচুর পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। মাছ খাদ্য কম খায়। পিএইচ বেশি হলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যায় এবং মাছের খাদ্য চাহিদা কমে যায়। দেহ খসখসে হয়। মাছ রোগাক্রান্ত হয়। পিএইচ কম হলে চুন, ডলোমাইড বা জিপসাম ১ থেকে ২ কেজি প্রতি শতাংশ পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ বেশি হলে পুকুরে তেঁতুল বা সাজনা গাছের ডালপালা তিনচার দিন ভিজিয়ে রেখে পরে তুলে ফেলতে হবে। তেঁতুল পানিতে গুলে দেয়া যায়।
পানির ওপর সবুজ স্তর :
পুকুরের পানির রঙ ঘন সবুজ হয়ে গেলে বা পানির ওপর শ্যাওলা জন্মালে খাদ্য ও সার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ১২ থেকে ১৫ গ্রাম তুঁতে বা কপার সালফেট অনেক ভাগ করে ছোট ছোট পোটলায় বেঁধে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানির নিচে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখতে হবে। প্রতি শতাংশ পুকুরে ৮০০ থেকে ১২০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে।
পানির ওপর লাল স্তর : পুকুরের পানির ওপর লাল স্তর পড়লে ধানের খড়ের বিচালি বা কলাগাছের শুকনো পাতা পেঁচিয়ে দড়ি তৈরি করে পানির ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিলে পরিষ্কার হয়।
পানির ঘোলাত্ব :
পানি ঘোলা হলে মাছ খাদ্য কম খায়, চোখে দেখে না, প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় না, প্রজননে সমস্যা হয় ও রোগবালাই বেশি হয়। প্রতি শতাংশে ৮০ থেকে ১৬০ গ্রাম ফিটকিরি দিতে হবে। পুকুর তৈরির সময় জৈবসার বেশি দিলে স্থায়ীভাবে ঘোলা দূর হয়। পানিতে কলাপাতা ও কচুরিপানা রাখলেও ঘোলা কমে।
পানির ক্ষারত্ব :
পানি ক্ষারীয় হলে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি কম হয়। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি কমে যায়। মাছের দেহে পিচ্ছিল পদার্থ কমে যায়। পুকুর তৈরির সময় ওপরে শতাংশ প্রতি ১ থেকে ২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। লেবু কেটে দিলেও ক্ষারত্ব কমে। ছাই প্রয়োগেও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ হয়।
জলজ উদ্ভিদ :
কচুরিপানা, কলমিলতা, চেচরা, পাতাঝাঝি, শাপলা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ এসব জলজ উদ্ভিদ জলাশয়ে রোদ পড়তে বাধা দেয়, মাছের চলাচল, খাদ্য গ্রহণ, প্রজননে সমস্যা করে। এসব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ কাঁচি দিয়ে কেটে সব সময় পুকুরের পানি ও পুকুর পরিষ্কার রাখতে হয়।
রোগবালাই :
শীতে মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ ও ফুলকা পচা রোগ হয়। এসব রোগ প্রতিরোধের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তাহলো-
১. পুকুরের পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা;
২. জলজ আগাছামুক্ত রাখা;
৩. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ার ব্যবস্থা করা;
৪. অনাকাক্সিক্ষত জলজ প্রাণী অপসারণ করা;
৫. অতিরিক্ত কাদা সরানো;
৬. দুই তিন বছর পর পর পুকুর শুকানো;
৭. নিয়মিত ও পরিমিত চুন প্রয়োগ করা;
৮. মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা;
৯. প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি পরীক্ষা করা;
১০. হররা টানা;
১১. পাখি বসতে না দেয়া;
১২. জাল শোধন করে ব্যবহার করা;
১৩. রোগাক্রান্ত মাছ অপসারণ করা;
১৪. সব সময় ঢেউয়ের ব্যবস্থা রাখা;
১৫. পানি কমে গেলে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা;
১৬. ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ করা;
১৭. পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করা;
১৮. পুকুরে বিভিন্ন স্থানে একটু গভীর বা গর্ত করা যাতে পানি কমে গেলে মাছ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
শীত ও গ্রীষ্মে প্রতিদিন পুকুরে যেতে হবে। পুকুরের অবস্থা দেখতে হবে। সাত দিন পর পর মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। আর মাছ সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা হলে উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এতে খরচ কমে যাবে, লাভ বেশি হবে।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে কুমিল্লার এক জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন মাছ হবে ২য় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ । এরই অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালে গণভবনের লেকে বঙ্গবন্ধু মাছের পোনা অবমুক্তকরণের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন । দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর দুরদর্শিতা বাস্তবে রূপ লাভ করেছে । তাই মুজিব শতবর্ষে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ মুজিব বর্ষে বাংলাদেশ’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মৎস্য অধিদপ্তর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে ।
মাছ চাষের মূল বিষয় :
তিনটি বিষয়ের উপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিষয়গুলো হলোঃ (১) ফিড (খাবার), (২) সিড (পোনা), (৩)ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা)। উক্ত বিষয়গুলোর একটির ঘাটতি হলেও মাছ চাষ ব্যাহত হয়। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে শীতকালীন মৌসুমী হাওয়া বইছে এবং এই সময়ে তাপমাত্রা ও অনেক কম থাকে বিধায় মাছ চাষে অনেক সমস্যা দেখা যায়। তাছাড়াও মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুনাবলি মাছ চাষের জন্য বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তাপমাত্রা কম ও ভৌত রাসায়নিক গুণাবলির সঠিক সমন্বয় মাটি ও পানিতে বিদ্যমান না থাকার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি জটিল হয়ে পড়ে।
অতীতে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ব্যাপক মৎস্য আহরণ সম্ভব ছিল কিন্তু বর্তমানে মনুষ্য সৃষ্টি কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে চাষের মাছের উপরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। আর অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করতে এবং অধিক উৎপাদন লাভের জন্য একদিকে যেমন অধিক পুঁজির প্রয়োজন তেমনি মাছের রোগবালাইসহ বিভিন্ন সমস্যা ও দেখা যায়। মুজিববর্ষে মাছ চাষে করণীয়সমূহ আলোচনা করা হলোঃ-
মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
রোগ জীবাণু দেহে প্রবেশ করার পর মাছের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়। অত্যন্ত উচ্চরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মাছে রোগ জীবাণুসহ সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। অপর পক্ষে, মাছের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হলে সহজেই রোগ হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা মাছের সার্বিক পরিবেশ, পানি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। উন্নত জলজ পরিবেশ, সুষম খাদ্য ও উত্তম খামার ব্যবস্থাপনার দ্বারা মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়।
মাছের ক্ষতরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ক্ষতরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান (জরংশ ঋধপঃড়ৎ) সমূহের উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত ০৪টি মৌলিক কৌশলের মাধ্যমে রাগ প্রতিরোধ/নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১. আক্রান্ত পুকুরে বিদ্যমান রোগ জীবাণু উচ্ছেদকরণ
ষ শুষ্ক মৌসুমে পুকুর সম্পূর্ণরূপে শুকানো, প্রয়োজনে তলদেশের পচাকাদা অপসারণ, বার বার চাষ দিয়ে চুন প্রয়োগ (শতাংশে ১ কেজি তবে মাটি ও পানির পিএইচ মাত্রার উপর চুন প্রয়োগের মাত্রা কম বেশি হয়)।
ষ কমপক্ষে ২/৩টি ফসল উঠানোর পর পুকুর শুকানো ও চুন প্রয়োগ (শতাংশে ১ কেজি)।
২. বাইরের রোগ জীবাণুর প্রবেশরোধ
- পুকুরের পাড় উঁচুকরণ, পাড়ের সকল রকম গর্ত ও অন্তরমুখী নালা বন্ধ করা যাতে বন্যাসহ অন্যান্য বাইরের পানি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
- পুকুরে নলক‚পের অথবা শোধিত পানি সরবরাহ করা, পুকুরের সাথে নদী-নালা, খাল-বিল বা অন্য কোন নর্দমা বা ড্রেন কেটে সংযোগ দেওয়া যাবে না। কারণ পানি রোগ জীবাণুর একটি অন্যতম প্রধান বাহক।
- রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ ও সবল পোনা লবণ জলেশোধন করার পর মজুদ করা (২.৫% লবণ জলে ২/৩ মিনিট বা সহ্যক্ষমতা অনুযায়ী ততোধিক সময়ে গোসল করানো)।
- পুকুরে সকল প্রকার বন্য মাছ, পোকা-মাকড়, কাকড়া, সাপ ব্যাঙ ইত্যাদির প্রবেশ রোধ করতে হবে। কারণ এরা বাইরের রোগ জীবাণু পুকুরের ভিতরে নিয়ে আসে।
- পুকুরে সকল গৃহপালিত/বন্য পশুপাখির আগমন রোধ করতে হবে।
- প্রাকৃতিক জলাশয়, ধানক্ষেত, হাওর, বাওড়, বিলের পানিতে কাজ করার পর পুকুরে নেমে হাত-পা বা অন্য কোন সামগ্রী ধৌত করা যাবে না।
- জালসহ অন্যান্য খামার সরঞ্জাম পুকুরে ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করতে হবে (বিøচিং পাউডার, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ইত্যাদি ব্যবহার করে)।
- খামারে/হ্যাচারিতে প্রবেশের পূর্বে খামার কর্মী ও দর্শানার্থদের পা, জুতা ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করা উচিত।
- রোগের যাবতীয় বাহক (ঈধৎৎরবৎ) যেমন- পানি, বন্যমাছ, মানুষ, গরু, ছাগল, পাখি, পোকামাকড় ইত্যাদি দ্বারা রোগ ছড়ানোর ব্যপারে সতর্ক হতে হবে।
৩. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাছের উপর শারীরিক চাপ পরিহার
- সঠিক উপায়ে পুকুর প্রস্তুতকরণ ( পুকুর শুকানো, তলদেশের পচাকাদা অপসারণ, বার বার চাষ দিয়ে শুকানো এবং চুন প্রয়োগ)।
- পানির উন্নত গুণাবলী বজায় রাখা (পিএইচ, অক্সিজেন, এ্যামোনিয়া ইত্যাদি)।
- মাছকে সকল প্রকার পরিবেশগত চাপ/পীড়ন থেকে মুক্ত রাখা যেমনÑ অতিরিক্ত মাছ মজুদ না করা। পরিমিত মাত্রায় সুষম খাদ্য প্রয়োগ। অতিরিক্ত জাল টানা বানড়া চড়ানা করা, যা মাছের শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষতের সৃষ্টি করে। কম ঘনত্বে মসৃণ পাত্রে মাছ পরিবহন করা। একই আকারের মাছ মজুদ করা। পানিতে নিয়মিত অক্সিজেন ঘাটতি, গ্যাসের আধিক্য বা দূষণ হলে পানি পরিবর্তন করা।
- শীতকালই ক্ষতরোগ সংক্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাই ইসময়ে মাছ ও তার পরিবেশ ও ঝুঁকি পূর্ণ সকল বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা।
- শীতের শুরুতে শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা (তবে এটা পানির ক্ষারত্বের উপর নির্ভর করে পরিবর্তনশীল)।
- অন্যান্য রোগ ও পরজীবীর ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
- আক্রান্ত এলাকায় রোগ সহিষ্ণু প্রজাতির মাছ মজুদ করা।
- মাছ ও খামারের নিয়মিত পরিচর্যা।
৪. মাছ ও খামারের নিয়মিত তদারকি ও মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা
মাছের আচরণের দিক দৃষ্টি রাখা। মাঝে মাঝে জালটেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। মাছ রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা ততসহজ নয়। রোগের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। তাইরোগ প্রতিরোধে পানির গুণাবলি উন্নয়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনা অধিক গ্রহণযোগ্য। সকল মৃত ও অর্ধমৃত মাছ অপসারণ করা ও মাটির নিচে পুঁতে ফেলা। দূষিত পানি পরিবর্তনে চুন প্রয়োগ (কলিচুন) ১ কেজি/শতক (পিএইচ ও ক্ষারত্বের উপর ভিত্তি করে)। জিওলাইট শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম ব্যবহার করে পানির এ্যামোনিয়াজনিত বিষক্রিয়া কমানো যায়।
এককোষী/বহুকোষী পরজীবী সংক্রমণ হলে ৫০ পিপিএম ফরমালিনে (৩৭%) ২৮ ঘণ্টা গোসল করাতে হবে। আরগুলাস (উকুন) সংক্রমণে ০.২৫ থেকে ০.৫০ পিপিএমডি পটারেক্স আক্রান্ত পুকুরে ১০/১৫ দিন অন্তর অন্তর ২/৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াজনিত ক্ষত বা পচন হলে ৫০ মি.গ্রা. টেট্রাসাইক্লিন/কেজি মাছকে প্রতিদিন খাবারের সাথে মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে। ছত্রাক সংক্রমণ করলে ২০০ পিপিএম লবণ জলে আক্রান্ত মাছকে ১ ঘণ্টা গোসল (সপ্তাহে ১ বার) অথবা আক্রান্ত পুকুরে ০.৫ পিপিএম মিথাইলিন বøু প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই অধিক শ্রেয়। মাছ চাষের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটির গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ একটি জলজ প্রাণী। পানির সঠিক ভৌত রাসায়নিক গুণাবলি অর্থাৎ সুস্থ জলজ পরিবেশের উপরই এদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি পাওয়া নির্ভর করে। অতএব, উন্নত জলজ পরিবেশ ও খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছকে সুস্থ রাখা অধিকতর সহজসাধ্য, কম ব্যয়বহুল, কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরিবেশ বান্ধব।
আরও পড়ুন: