মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ।

মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

 

মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

 

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমির সমন্বয়ে গঠিত এদেশ। এদেশের স্বাদু পানিতে রয়েছে দেশি-বিদেশি মিলে ২৭২ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি; সামুদ্রিক উৎসে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। এ বিপুল মৎস্য সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য আহরণ নীতিমালা, মৎস্য আহরণ সরঞ্জাম ব্যবহার এবং মৎস্য বাজারজাতকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন ।

মৎস্য আহরণ বা মৎস্য শিকারের মূলনীতি :

বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, নদী, পুকুর ডোবা ও বঙ্গোপসাগরে বিদ্যমান মৎস্য সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এসব উৎস হতে মৎস্য শিকার বা আহরণের জন্য কত গুলো মূলনীতি অনুসরণ করা অতীব প্রয়োজন। মৎস্য শিকারের মূলনীতিমালা হলো-

  • সঠিক মাত্রায় বা সহনীয় মাত্রায় মাছ আহরণ করতে হবে।
  • মাছের ঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে মাছ ধরতে হবে। যেমন- পুকুর বা নদীতে মাছের প্রজনন হার, প্রাকৃতিক প্রাচুর্য ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য রেখে মাছ ধরা উচিত। প্রজননের সময় মাছ আহরণ বা ধরা নিষিদ্ধ ।
  • মৎস্য আহরণ বা মাছ ধরার মূলনীতির একটি হলো- কম খরচে বেশি আহরণ করা, আবার মাছের পোনা উৎপাদন, কৃত্রিম খাদ্য তৈরি ইত্যাদিতে কম খরচে বেশি মাছ উৎপাদন করা ।
  • পুরাতন বা সনাতন যন্ত্রপাতি (Gear) ব্যবহারের পরিবর্তে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা।
  • কম সংখ্যক জনবল নিয়োগ করে অধিক পরিমাণে মৎস্য আহরণ করা ।
  • অতিরিক্ত মাত্রায় মাছ আহরণ কমানো।
  • জলাশয়ে অত্যধিক মাছের ঘনত্ব থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করা ।

মাছ আহরণকালীন সময়ে করণীয় :

পুকুর থেকে মাছ আহরণ বা ধরার পূর্বের দিন পুকুরে অবশ্যই জাল টেনে নিতে হবে এবং সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। এতে মাছ পাকা হবে অর্থাৎ মাছের দেহ শক্ত হবে। কারণ মাছের পেটে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য থাকলে জীবিত অবস্থায় যে এনজাইম খাদ্য হজমে সহায়তা করতো ঠিক সেই এনজাইম এবং পচনকারী ব্যাকটেরিয়া মাছ মরার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত মাছকে পচাতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও যেসব মাছ Active feeding অবস্থায় থাকে তাদের দেহ নরম হয়। আঞ্চলিক ভাষায় সেসব নরম দেহ বিশিষ্ট মাছকে কাঁচা মাছ বলে।

বাজারে এসব কাঁচা মাছের মূল্য পাকা মাছের তুলনায় অনেক কম । একজন দক্ষ পাইকার মাছ হাতে নিয়েই বলে দিতে পারে উক্ত মাছ কাঁচা না পাকা। সঠিক বাজারমূল্য প্রাপ্তির নিমিত্তে মৎস্যচাষিকে অবশ্যই উল্লেখিত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। তবে পাঙ্গাশের ক্ষেত্রে একদম খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখা এবং জাল টানা যাবে না।

পুকুর খুব বড় হলে পুরো পুকুরে একবারে জাল না টেনে আংশিকভাবে জাল টানতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যের অর্ধেক পরিমাণ প্রয়োগ করা যেতে পারে। আবার অনেকেই বিশেষ করে পুকুরে মাছ যখন কমে যায় তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুকুর হতে মাছ ধরার সময় মাছকে ধরে বেশ কিছু সময়ের জন্য হাপাতে রাখেন । এমনকি কখনও কখনও প্রায় ১০-১২ ঘণ্টাও মাছকে এভাবে রাখা হয় । মাছকে এভাবে হাপায় রাখলে পালানোর জন্য মাছ অবিরামভাবে চেষ্টা করে। ফলে মাছের দেহে প্রচুর ল্যাকটিক এসিড জমে। এ কারণে এভাবে রাখা মাছের ক্ষেত্রে মাছ মরার সঙ্গে সঙ্গেই গুণগতমানের যথেষ্ট অবনতি ঘটে।

বাজারে এ অবস্থায় উত্তোলিত মাছকে আঞ্চলিক ভাষায় বাসি মাছ বলে। সদ্য ধৃত মাছ এবং বাসি মাছের বাজারমূল্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়। তাই সম্ভব হলে সদ্য ধৃত বা টাটকা মাছ বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করলে ভালো বাজার মূল্য পাওয়া যাবে। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছ তুলে বাজারজাতকরণ করতে হবে। সম্ভব হলে ঈদ, পূজা ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে অতি সকালে মাছ বাজারজাত করতে হবে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

মাছ বাজারজাতকালীন সময়ে করণীয় :

মাছ অত্যন্ত দ্রুত পচনশীল। আর এই পচনশীলতার মূল কারণ হলো-এর গঠনশৈলী অর্থাৎ পানির উপস্থিতি (৬৬-৮৪%)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবহনের সময় হাত বদলের কারণে ধৃত স্থান হতে ক্রেতা সাধারণের নিকট পৌঁছার অনেক আগেই মাছের গুণগত মানের প্রায় ৭০% নষ্ট হয়ে যায় । বিশেষ করে কিছু কিছু প্রোটিনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। ফলে পুষ্টি সাধনের যে উদ্দেশ্যে আমরা মাছ গ্রহণ করে থাকি সে উদ্দেশ্য সফল হয় না।

শুধু তাই না সদ্যধৃত মাছ বা টাটকা মাছ এবং অনেক পূর্বে মৃত মাছের বাজার মূল্যেরও বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয় । তাই ধৃত মাছ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুব সকালে নিকটবর্তী বাজারে টাটকা অবস্থায় বিক্রির ব্যবস্থা করলে মাছের ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যেতে পারে।

এছাড়াও একটু বেশি দূরত্বে পরিবহনের ক্ষেত্রে মাছের গুণগতমান অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াসে বরফে সংরক্ষণ, হিমায়ন ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই শুধু মাছের উৎপাদনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখলেই চলবে না। উৎপাদিত মাছের যেন সঠিক বাজার মূল্য পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। আর বরফে সংরক্ষণ করা হলে তা সঠিক নিয়মে করা দরকার, নতুবা মাছের গুণগতমান ঠিক থাকবে না। একভাগ মাছ এবং এক ভাগ বরফ এভাবে পর্যায়ক্রমে মাছ এবং বরফ দিয়ে বাঁশের ঝুড়িতে মাছ সাজাতে হবে।

 

মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

 

মাছের আংশিক ও পূর্ণ আহরণ :

মাছের আংশিক আহরণ হলো বাজারজাত যোগ্য বড় মাছগুলো সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ বা আহরণ করা। আংশিক আহরণ অধিক উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। কারণ প্রত্যেকটি জলাশয়ের একটি নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা আছে। মাছের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ওজন ধারণক্ষমতার যত কাছাকাছি যাবে মাছের বৃদ্ধির হার তত কমে যাবে ।

ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে গেলে মাছ আর বাড়বে না। যেমন- কার্পজাতীয় মাছের ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যবস্থাপনায় পুকুরের ধারণক্ষমতা ২০ কেজি/শতাংশ। তবে প্রজাতি ও ব্যবস্থাপনা ভেদে জলাশয়ের এ ধারণক্ষমতা পরিবর্তনশীল । যেমন- পাংগাসের ক্ষেত্রে এর ধারণক্ষমতা কার্পের চেয়ে দ্বিগুণ। মাছ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যখনই ধারণক্ষমতার কাছাকাছি আসবে তখনই বড় আকারের মাছগুলো ধরে সে প্রজাতির উত্তোলনকৃত মাছের সংখ্যার সাথে ১০% যোগ করে পুনঃ মজুদ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

আবার কার্পজাতীয় মাছের ওজন যখন ৪০০-৬০০ গ্রাম বা তার কাছাকাছি হয়ে যায় তখন তাদের বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কমে যায়। তখন দেখা যায় মাছ খায় বেশি কিন্তু সে হারে বাড়ে না। তাছাড়া মাছ বাজারজাতকরণের বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখা যায় ৫০০ গ্রাম বা কিছু বেশি ওজনের মাছই অধিক হারে বাজারে বিক্রি হয়। যেহেতু এ ওজনের মাছের ক্রেতা বেশি থাকে তাই যখনই মাছ উল্লেখিত ওজনের কাছাকাছি যাবে তখনই বড় সাইজের মাছগুলো আংশিক আহরণ করে পুনঃ পোনামজুদ করা উচিত।

তাছাড়া এভাবে আংশিক আহরণ ও পুনঃ মজুদ করা হলে মাছের চুরিজনিত ক্ষতির ঝুঁকিও কমে আসবে। বছর শেষে সম্পূর্ণ মাছ বা পূর্ণ আহরণ করা যেতে পারে। তবে বানিজ্যিক ভিত্তিতে মাছচাষ করলে ১ কেজির নিচের আকারের মাছ বিক্রি লাভজনক নয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment