আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় চাষযোগ্য মাছের সাধারণ রোগ, রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার বা চিকিৎসা।
চাষযোগ্য মাছের সাধারণ রোগ, রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার বা চিকিৎসা
জীবমাত্রই মরণশীল। মাছ এর বাইরে নয় । অনেক ক্ষেত্রে রোগের কারণে অস্বাভাবিকভাবে ব্যাপক হারে মাছের মৃত্যু ঘটে। তাই রোগ প্রতিকার বা প্রতিরোধকল্পে রোগ কী, কেন মাছ রোগাক্রান্ত হয়, রোগাক্রান্ত মাছের লক্ষণসমূহ, রোগ নিরাময়ের উপায় বা প্রতিরোধে করণীয় কী, ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন । এ অধ্যায়ে চাষযোগ্য মাছের সাধারণ রোগ, রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা করা হলো ।
রোগ কী :
রোগ হলো দেহ ও মনের অস্বাভাবিক অবস্থা, যা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ, চিহ্ন বা আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন- ক্ষতরোগ হলে মাছের গায়ে লাল দাগ ও ক্ষত দেখা যায়। পরবর্তীতে এ দাগে পচন ধরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। আবার আরগুলোসিস বা মাছের উকুনজনিত রোগ হলে মাছ অস্থিরভাবে ছুটাছুটি করে। অনেক সময় পরজীবীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাছ শক্ত কোন কিছুর সঙ্গে গা ঘষতে থাকে, ইত্যাদি । উল্লেখিত লক্ষণসমূহ দেখে বুঝা যায় মাছ রোগাক্রান্ত হয়েছে।
কেন মাছ রোগাক্রান্ত হয় :
রোগ সৃষ্টির জন্য ৩টি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক দায়ী। এগুলো হলো- রোগজীবাণু, রোগজীবাণুর জন্য অনুকূল পরিবেশ এবং পোষক। পোষক, রোগজীবাণু এবং পরিবেশ যখন সাম্যাবস্থায় বিদ্যমান থাকে তখন রোগ সৃষ্টি হয় না। অথচ এগুলোর মধ্যে যখন ভারসাম্য নষ্ট হয় অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থার অবনতি ঘটে তখনই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় ও রোগজীবাণুর সংখ্যাধিক্য ঘটে। এরূপ অবস্থায় রোগজীবাণু মাছের দেহে আশ্রয় নেয় এবং সুযোগ পেলেই মাছকে আক্রমণ করে, তখন মাছ রোগাক্রান্ত হয়। রোগজীবাণুর মাত্রা যতই বাড়তে থাকে, আক্রমণের তীব্রতা ততই বাড়তে থাকে ।
মাছে রোগ সৃষ্টির কারণসমূহ:
- মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো।
- অধিক ঘনত্বে মাছ মজুদ করা; পর্যাপ্ত পরিমাণ সুষম খাদ্যের অভাব;
- বসবাসরত পরিবেশ দূষিত হওয়া;
- পরিবহনের সময় পোনার ওপর পরিবহনজনিত চাপ পড়া, পোনা দুর্বল হওয়া বা পোনা আহত হওয়া;
- বিভিন্ন বয়সের পোনা একসাথে মজুদ করা; চাষকৃত পুকুরে বাজে মাছ বা জলজ আগাছা থাকা ও
- অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বন ডাই-অক্সাইড, তাপমাত্রা, ক্ষারত্ব প্রভৃতি সর্বানুকূল অবস্থায় বিদ্যমান না থাকা ইত্যাদি ।
মাছকে রোগমুক্ত রাখার উপায়সমূহ:
- চাষকৃত মাছকে রোগমুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই নিম্নোক্ত নির্দেশাবলি সতর্কতার সাথে পালন করতে হবে।
- জলজ পরিবেশের বিভিন্ন গুণাবলি, যেমন- দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, তাপমাত্রা, মোট ক্ষারত্ব প্রভৃতি মাছচাষের অনুকূলে রাখা;
- সঠিক মজুদ ঘনত্ব বজায় রাখা তথা চাষকৃত মাছের প্রজাতি, বয়স, পুকুরের ভৌত-রাসায়নিক অবস্থা,
- মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার ধরন, খাদ্যের মান প্রভৃতি বিবেচনা করে পোনা মজুদ করা;
- পোনা পরিবহনের সময় পোনা যেন কোনো আঘাত বা চাপের সম্মুখীন না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে পোনা শোধন করে পরে পরিবহন
- পাত্র এবং পুকুরের পানির সমতা আনয়ন করে পুকুরে পোনা মজুদ করা; –
- বিভিন্ন বয়সের মাছ পৃথকভাবে লালন পালন করা, কারণ সব বয়সের মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক নয়। আবার মাছ যেহেতু দলবদ্ধভাবে বসবাস করে তাই মাছের ক্ষেত্রে এক মাছ রোগাক্রান্ত হলে, অন্য মাছও সংক্রমিত হতে পারে। সম্ভব হলে বিভিন্ন বয়সের মাছ অবশ্যই আলাদাভাবে চাষ করতে হবে। কোন ক্রমেই ব্রুড মাছের পুকুরে ছোট পোনা রাখা যাবে না;
- মাছের বসবাসরত পরিবেশের উন্নয়ন সাধনকল্পে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করে পুকুরকে জীবাণুমুক্ত করে
- মাছকে রোগমুক্ত রাখা যেতে পারে;
- প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরিমাণে সুষম সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা; –
- রোগাক্রান্ত পুকুরে ব্যবহৃত উপকরণাদি (জাল, পরিবহন পাত্র ইত্যাদি) প্রয়োজন হলে জীবাণুমুক্ত করে পরে তা অন্য পুকুরে ব্যবহার করা ;
- মৃত বা মৃতপ্রায় রোগাক্রান্ত মাছকে পুকুর হতে অপসারণ করা;
- সম্ভব হলে প্রতি বছর বা ২/৩ বছর পর পর পুকুর শুকিয়ে তলার অতিরিক্ত পঁচা কাদা তুলে ফেলা;
- মাঝে মাঝে হড়রা টেনে বা জিয়োলাইট প্রয়োগ করে পুকুরের তলদেশে সঞ্চিত দূষিত গ্যাস দূর করা;
- পুকুরে পানি পরিবর্তন করে বা আংশিক কমিয়ে ফেলে নতুন পানি সরবরাহ করা;
- পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করা;
- বাইরে থেকে নোংরা পানি ঢুকতে না দেয়া;
- রোগজীবাণু ও পরজীবীমুক্ত মাছ প্রজননের জন্য নির্বাচন করা;
- পুকুরে পাখি বসতে না পারে সেজন্য বাঁশ বা ডালজাতীয় কোন অবলম্বন না রাখা। তবে অনেকক্ষেত্রে ডালে জন্মানো শ্যাওলা রুই জাতীয় মাছের প্রিয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়;
- সম্ভব হলে পুকুরে গবাদি পশু গোসল
- এবং রোগাক্রান্ত মাছ ধোয়া থেকে বিরত থাকা।
উল্লিখিত কার্যাদি সম্পন্ন করে সঠিক ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ করে পুকুরের চাষকৃত মাছকে রোগমুক্ত রাখা যেতে পারে । মাছের রোগমুক্তির জন্য সাবধানতা অবলম্বন করার পরেও অনেক সময় দেখা যায় মাছ রোগাক্রান্ত হয়েছে । তখন রোগাক্রান্ত মাছের চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে চিকিৎসা শুরুর পূর্বে রোগাক্রান্ত ও সুস্থ মাছের কী ধরনের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান তা নির্ণয় করতে হবে। নিচে রোগাক্রান্ত ও সুস্থ মাছের সাধারণ কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হলো।
সুস্থ ও রোগাক্রান্ত মাছের সাধারণ লক্ষণসমূহ:
মাছের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অসঙ্গতি বা বিকৃতি এবং শারীরবৃত্তীয় বিঘ্নতা বা জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে রোগের লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হয়ে থাকে। সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ রোগাক্রান্ত মাছের বৈশিষ্ট্য ও আচরণ থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। একটি রোগাক্রান্ত মাছ চিনতে হলে প্রথমে একটি সুস্থ মাছের বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা থাকতে হবে।
আরও দেখুনঃ