আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছচাষে প্রতিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব।
মাছচাষে প্রতিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব
প্রতিবেশ বলতে কোনো স্থানের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বুঝায় । একটি স্থানের প্রতিবেশ হলো সে স্থানের আলো, বাতাস, মাটি, পানি, তাপমাত্রা প্রভৃতি যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। প্রতিবেশ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যথা- জলজ প্রতিবেশ, স্থলজ প্রতিবেশ, মরুজ প্রতিবেশ ও সামুদ্রিক প্রতিবেশ ইত্যাদি । নিচে জলজ প্রতিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
জলজ প্রতিবেশ
পানিতে বিদ্যমান জৈব উপাদান যেমন- মাছ, পোকামাকড়, উদ্ভিদ, শ্যাওলা, প্ল্যাংকটন, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি এবং পারিপার্শ্বিক অজৈব উপাদান যেমন- আলো, তাপমাত্রা, মাটি, পানি ও মাটিতে বিদ্যমান নানা প্রকার পদার্থের সমন্বয়ে জলজ প্রতিবেশ গঠিত। জলজ প্রতিবেশ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন—
ক. স্বাদু পানির প্রতিবেশ
খ. লোনা পানির প্রতিবেশ ও গ. মোহনার প্রতিবেশ
ক. স্বাদু পানির প্রতিবেশ
যে পানিতে লবণাক্ততা নেই বা সামান্য পরিমাণে আছে অর্থাৎ শূন্য (০) পিপিটি থেকে ০.৫ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা থাকে তাকে স্বাদু পানি বলা হয়। স্বাদু পানিতে বিদ্যমান জৈব ও অজৈব উপাদানের সমন্বয়ে স্বাদু পানির প্রতিবেশ গঠিত। স্বাদু পানির প্রতিবেশ দুই প্রকারের হতে পারে। যথা-
১. স্রোতহীন পানির প্রতিবেশ : যে জলজ প্রতিবেশের পানি স্থির থাকে তাকে স্রোতহীন পানির প্রতিবেশ বলে । যেমন- পুকুর, দিঘি, হ্রদ, বাঁওড় ইত্যাদি।
২. স্রোতশীল পানির প্রতিবেশ : যে জলজ প্রতিবেশে স্রোত থাকে তাকে স্রোতশীল পানির প্রতিবেশ বলে। যেমন- নদ-নদী, ঝর্ণা ইত্যাদি।
খ. লোনা পানির প্রতিবেশ
যে পানিতে লবণাক্ততা ৫.০ পিপিটি থেকে ৩০.০ পিপিটি বা তার চেয়ে বেশি থাকে তাকে লোনা বা লবণাক্ত পানি বলে । লোনা পানিতে বিদ্যমান জৈব উপাদান ও অজৈব উপাদানের সমন্বয়ে লোনা পানির প্রতিবেশ গঠিত হয় ।

গ. মোহনার প্রতিবেশ
নদী ও সমুদ্রের সংযোগ স্থলকে মোহনা বলে। মোহনা হলো এমন পানির অঞ্চল যেখানে নদীর পানি সাগরের পানির সাথে মিশে সাগরের পানিকে অধিকতর তরল করে। মোহনার পানি আধা লবণাক্ত প্রকৃতির, যার মাত্রা ০.৫ পিপিটি থেকে ৫.০ পিপিটি পর্যন্ত। মোহনাকে বাফার জোন বলা হয়। অর্থাৎ নদ-নদীর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টি উপাদান মোহনায় এসে মিলিত হয় বলে মোহনায় মাছের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য তৈরি হয়। তাই মোহনায় মাছসহ বিভিন্ন জীবের আধিক্য বেশি থাকে ।
ইকোসিস্টেম (Ecosystem) বা বায়ুসংস্থান
প্রকৃতিতে জৈব ও অজৈব পরিবেশ পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং একটি থেকে আরেকটি আলাদা করা যায় না। প্রকৃতির কোন স্থান যেখানে জৈব ও অজৈব পদার্থ বিদ্যমান থেকে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এক অংশ থেকে আরেকাংশে (অজৈব থেকে জৈব এবং জৈব থেকে অজৈব অংশে) বস্তুর আদান-প্রদান ঘটায় তাকেই ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান বলে। ইকোলজিক্যাল পদ্ধতির দুইটি অংশ আছে। একটিকে স্বতঃপুষ্ট বা Autotrophic অপরটিকে পরঃপুষ্ট বা Heterotrophic বলে। যারা সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে সরল অজৈব পদার্থ থেকে জটিল জৈবিক পদার্থ প্রস্তুত করে এরাই স্বতঃপুষ্ট।
যেমন- সৰ সবুজ উদ্ভিদ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আবার যারা সরল অজৈব পদার্থ থেকে জটিল জৈব পদার্থ তৈরি করতে পারে না, বা নিজেরা নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে পারে না তারাই পরঃপুষ্ট। যেমন- সমস্ত প্রাণিকূল, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এরা শুধু সবুজ উদ্ভিদ কর্তৃক তৈরিকৃত খাদ্যসমূহকে সদ্ব্যবহার করে, পুনঃবিন্যাস করে এবং পচার। অর্থাৎ ইকোসিস্টেম চলতে হলে অবশ্যই তা অজৈব রূপ থেকে সালোকসংশ্লে ষণের মাধ্যমে জৈব রূপে যেতে হবে এবং তা আবার ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দ্বারা পচে জৈব রূপ থেকে অজৈব রূপে ফিরে আসতে হবে। উপরের ১৪ নং চিত্রের মাধ্যমে তা দেখানো হলো।
ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের ৪টি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো-
১. জৈব ও অজৈব পদাথ,
২. উৎপাদনকারী:
৩. গ্রাহক বা তক্ষক এবং
৪. পচনকারী।
১. জৈব ও অজৈব পদার্থ
পানি, কার্বনডাই-অক্সিইড (CO2), অক্সিজেন (O2), ক্যালসিয়াম (Ca), নাইট্রোজেন (N2) ফসফরাস (P) জাতীয় লবণ, অ্যামাইনো এসিড, হিউমিক এসিড ইত্যাদি অজৈব ও জৈব বস্তুসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
২. উৎপাদনকারী :
সবুজ উদ্ভিদকুল এ দলের অন্তর্ভুক্ত । কারণ এরা সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে সরল অজৈব পদার্থ থেকে জটিল জৈব পদার্থ প্রস্তুত করতে সক্ষম।
৩. গ্রাহক বা ভক্ষক :
সমস্ত প্রাণিকূল এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ উদ্ভিদ খেয়ে বাঁচে। যেমন- হরিণ ঘাস খায় আবার বাঘ হরিণ খায়। এখানে হরিণ প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাঘ হরিণ খায় বলে পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল।
৪. পচনকারী :
ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক এ দলে পড়ে । মৃতজীবকে ভেঙে এরা নিজেদের খাদ্য তৈরি করে । ফলে জীবের জটিল জৈবিক উপাদানসমূহ ভেঙে সরল উপাদানে বা অজৈব উপাদানে রূপান্তরিত হয়। এর ফলেই মৃতজীব পচে জীবের মূল উপাদানসমূহ আবার পরিবেশে ফিরে আসে।
আরও দেখুন: