আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নাইলোটিকা চাষের সুবিধা – যা মৌসুমি পুকুরে মাছচাষ এর অন্তর্ভুক্ত।
নাইলোটিকা চাষের সুবিধা
নাইলোটিকা চাষের সুবিধা
- তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন করা যায়;
- অতি সাধারণ ও সহজ ব্যবস্থাপনায় এদের চাষ করা যায়;
- রোগ বালাই প্রতিরোধক্ষম
- অধিক কষ্ট সহিষ্ণু ও বেশি ঘনত্বে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত । যেমন ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সহজেই টিকে থাকতে পারে;
- জৈবিক এবং কৃষিজ বর্জ্যকে সহজেই উন্নত আমিষে রূপান্তর করতে সক্ষম;
- সহজেই এ মাছের পোনা পাওয়া যায়;
- শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা যেকোনো মৌসুমে এদের চাষ করা যায় ও
- একই পুকুরে বছরে ২ বার চাষ করা যায়।
মাইলোটিকার শারীরিক গঠন :
নাইলোটিকা মাছটি ধূসর নীলাভ থেকে সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। প্রায় সমস্ত পিঠ জুড়েই কাঁটাযুক্ত পৃষ্ঠ পাখনা আছে। পিঠের পাখনাটি অনেকটা কৈ মাছের পাখনার মতো। পিঠের ও পায়ু সংলগ্ন পাখনা সাদা রঙের সরু ও লম্বা দাগযুক্ত। পুরুষ মাছের গলার অংশ প্রজনন কালে লালচে দেখায়। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই গেট ও অঙ্গীরদেশ লালচে দেখায় যা পুরুষের বেলায় বেশি উজ্জ্বল।
পূর্ণ প্রজনন অবস্থায় পুরুষের পিঠে লালচে আভা লেজের পাখনা পর্যন্ত বিস্তৃতি পেরে ঘন রক্ত বেগুনি রং ধারণ করে। শ্রোণী পাখনা কালো বর্ণের হয়ে থাকে। পরিপক্ক পুরুষ ও স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রির পরীক্ষা করলে দেখা যায়, পুরুষ মাছের জননেন্দ্রিয় দুই ছিদ্র বিশিষ্ট সাদা ও লম্বাটে আর স্ত্রী মাছের বেলার তা ভিন ছিদ্র বিশিষ্ট, খাটো ও লালচে রঙের হয়।

সাইটের জীবনচক্র :
তিন মাস বয়সে তেলাপিয়া নাইলোটিকার শারীরিক ওজন যখন ৫০-৬০ গ্রামে পৌঁছে তখন এরা প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। প্রজননক্ষম পুরুষ মাছ পুকুর এবং বদ্ধ জলাশয়ের অগভীর অঞ্চলে শক্ত মাটিতে তার শরীরের দৈর্ঘ্যের তুলনায় দ্বিগুণ বাসের স্থান জুড়ে প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত করে এবং তার পছন্দের প্রজননক্ষম স্ত্রী মাছকে বাসায় ডিম ছাড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানার। বেশির ভাগ তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে ডিম ছাড়ার প্রাক্কালে স্ত্রী ও পুরুষ মাছের প্রণয় ও বাহ্যিক দৈহিক মিলনের আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
বিশেষ করে পুরুষ মাছ স্ত্রী সঙ্গীকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রদর্শন করে থাকে (যেমন- পৃষ্ঠ পাখনা দাঁড় করানো এবং মোহনীয় শারীরিক ভঙ্গিমা প্রদর্শন ইত্যাদি)। পছন্দের সঙ্গী পাওয়া মাত্রই তাকে নির্মিত বাসার প্রবেশের অধিকার দিয়ে থাকে। স্ত্রী মাছ তার পুরুষ সঙ্গীর সাথে সঠিক মিলন আচরণ বিনিময়ের ফলে বাসায় ডিম পাড়ার উদ্যোগ নেয়। ডিম ছাড়ার প্রাকালে স্ত্রী মাছ বাসার তলদেশে জননেন্দ্রিয়ের অগ্রভাগ স্পর্শ করে প্রতিবারে ৩০-৬০টি ডিম ছেড়ে দেয়। স্ত্রী মাছের মোহনীয় আচরণে মুগ্ধ হয়ে পুরুষ সঙ্গী প্রতি ব্যাচ ডিম ছাড়ার পর পরই শুক্র নিঃসরণের মাধ্যমে ডিমগুলো নিষিক্ত করে।
নিষিক্ত ডিমের রং হয় ঈষৎ হলুদ এবং কমলার মিশ্রণ। নিষিক্ত হওয়ার পর পরই স্ত্রী মাছ ডিমগুলো মুখে তুলে নিয়ে ঐ স্থান ত্যাগ করে এবং মুখের মধ্যে রেখেই তা দিরে ভিম ফুটিরে পোনা তৈরি করে। সাধারণত ২৮°১০ সেলসিয়াস তাপমাত্রার মুখে ডিম ফুটতে ৭০-৯০ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এ সময় স্ত্রী মাছ কুটে যাওয়া লার্ভিগুলোকে পূর্ণাঙ্গ পোনায় রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত আরো ৬-১০ দিন মুখে রেখে যত্ন ও নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। উল্লেখ্য যে, এ সময়ে মা মাহ বাহির থেকে কোনো রূপ খাদ্য গ্রহণ করে না।
সাধারণত ১২ দিনের দিন স্ত্রী মাছ পোনাগুলোকে মুখ থেকে ছেড়ে দেয়। কারণ ১২ দিনের পূর্বে পোনা গুলো ছেড়ে দিলে দেখা যার পোনাগুলো পেটে লেগে থাকা ডিমগুলির জন্য পানিতে সহজে সাঁতার কেটে চলাচল করতে পারে না। তাই ১২ দিন পর ডিমগুলো নিঃশেষ হয়ে গেলে এবং বাহির থেকে খাদ্য গ্রহণে সক্ষম হলে তখনই মা মাছ তার অভিভাবক সুলভ আচরণ (Parental Care) ছেড়ে দেয়। প্রায় তিন মাসের মধ্যে পোনাগুলো বড় হয়, তখন এদের ওজন হয় প্রায় ৭০-৮০ গ্রাম এবং তখনই তারা প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে।
নাইলোটিকার চাষ পদ্ধতি :
মৌসুমি পুকুরে ২ ধরনের ব্যবস্থাপনায় নাইলোটিকা মাছচাষ করা হয়ে থাকে । যেমন-
ক. সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতি খ. আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতি। নিচে উভয় ধরনের মাছচাষ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো ।
ক. সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিটি খুবই সহজ। ৩ থেকে ৪ মাস ২-৩ ফুট পানি থাকে এমন ছোট গর্ত, ডোবা, ইত্যাদি জলাশয়ে এ পদ্ধতিতে তেলাপিয়া মাছের চাষ করা যায় । তবে জলাশয়ের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং তা আয়তাকার হলে এ মাছ চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক। স্বল্প ব্যয়ে, কম সময়ে, ছোটখাটো জলাশয়েও এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করা যায়। এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় সম্পূরক খাদ্য হিসেবে চালের কুঁড়া কিংবা সরিষার খৈল প্রয়োগ করতে হয় না। শুধুমাত্র জৈব ও অজৈব সার দিলেই চলে।
পুকুর প্রস্তুতি :
অন্যান্য মাছচাষের মতোই সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুর প্রস্তুত করতে হবে । প্রথমে পুকুরে জলজ আগাছা থাকলে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। এর পরে সম্ভব হলে সেচের মাধ্যমে পুকুর শুকিয়ে রাক্ষুসে মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে এবং প্রয়োজন হলে পুকুরের তলদেশ এবং পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে। পারিবারিক বা অন্যান্য যে কোনো কারণে পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করতে হবে অথবা মাছ মারার ঔষধ হিসেবে প্রতি শতাংশে প্রতিফুট পানির জন্য ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে।
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ অপসারণের পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এতে মাটি ও পানির অম্লত্ব দূর হবে এবং বিভিন্ন রোগের জীবাণু ধ্বংস হবে। চুন প্রয়োগের ১ সপ্তাহ পরে শতাংশ প্রতি ৩-৪ কেজি পচা গোবর প্রয়োগ করতে হবে। গোবরের পরিবর্তে শতাংশ প্রতি ৫-৭ কেজি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। পানি ভর্তি পুকুরে জৈব সার প্রয়োগের ৬-৭ দিনের মধ্যেই পানি সবুজ রঙের হয়ে যায় । যদি চুন ও গোবর প্রয়োগের পরেও পানি যথেষ্ট সবুজ রং ধারণ না করে তবে শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৭৫ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি পাত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গোবর সার নিয়ে এর মধ্যে হিসেব মতো টিএসপি সার মিশিয়ে পানি দিয়ে গুলে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এর পরে পুকুরে প্রয়োগের সময়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়া সার মিশিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে গোবর ও সারের মিশ্রণ পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৩-৪ দিনের মধ্যে পানির রঙ সবুজ হলে জলায়তন হিসেব করে পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে।

পোনা মজুদ ও খাদ্য প্রয়োগ :
সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতিতে শতাংশ প্রতি ৮-১০ গ্রাম ওজনের ৩০-৩৫টি সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। পোনা মজুদের পরে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাত দ্বারা প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যবেক্ষণ বা গামছা গ্লাস পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য না থাকলে সার প্রয়োগের পাশাপাশি চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, সরিষার খৈল গুঁড়া করে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মাঝে মাঝে নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের মোট জীবভর জেনে দৈহিক ওজনের কমপক্ষে ৪-৫% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ :
উপরে উল্লিখিত সব ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পালন করলে ৩-৪ মাস পর মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হবে এবং প্রত্যেকটি মাছের ওজন গড়ে ১০০-১২৫ গ্রাম হবে। মাছ আহরণের ক্ষেত্রে খেপলা জাল, বড়শি, ধর্মজাল, বেড়জাল প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে নাইলোটিকা যেহেতু পুকুরে গর্ত করে তাই বার বার বেড় জাল টেনেও খুব সহজেই সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করা যায় না। সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হলে পানি কমিয়ে বা পুকুর শুকিয়ে মাছ আহরণ করতে হবে।
খ. আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতি :
আধা-নিবিড় ব্যবস্থাপনাকে আদর্শ মৎস্যচাষ ব্যবস্থাপনা বলা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় কতিপয় ছোট-বড় পুকুর প্রয়োজন হয়। পুকুরের আয়তন, মাছের মজুদ ঘনত্ব, পানির গভীরতা, অবাঞ্ছিত মাছ অপসারণ ও সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ প্রভৃতির সমন্বয় সাধন করেই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আধা-নিবিড় ব্যবস্থাপনায় ৬ মাস পর পর বছরে ২ বার মাছ আহরণ করা
যায়। এ ধরনের চাষ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নিচে বর্ণিত ধাপসমূহ অনুসরণ করা হয়।
১. প্রজনন পুকুর তৈরিকরণ ও পুকুর প্রস্তুতি;
২. প্রজননক্ষম মাছ প্রতিপালন;
৩. আঁতুড় পুকুরে রেণুপোনা প্রতিপালন;
৪. লালন পুকুরে পোনা প্রতিপালন ও
৫. মজুদ পুকুরে মাছ প্রতিপালন ।
১. প্রজনন পুকুর তৈরিকরণ ও পুকুর প্রস্তুতি :
প্রজননক্ষম তেলাপিয়া পালনের জন্য ছোট আকারের পুকুর হলে ভাল হয়। সাধারণত ৫-১০ শতাংশ আয়তনের পুকুর ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এ ধরনের মাছচাষের ক্ষেত্রে পুকুরের ঢাল বেশি হলে ভালো হয়। কারণ ঢাল কম হলে মাছ ধরার অসুবিধা হয়। আর গভীরতার ক্ষেত্রে পুকুরের গভীরতা ১ মিটার বা প্রায় ৩ ফুট হলে তা মাছ চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। পুকুরের পাড়টি পানিতল থেকে অন্তত ১ মিটার উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে অতি বৃষ্টিতে পুকুরের পাড় ভেসে যেতে পারে।
পুকুর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতির ন্যায় রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ, চুন প্রয়োগ, সার প্রয়োগ প্রভৃতি কাজ গুলো ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। চুন ও সার প্রয়োগের পর পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হলে প্রজননক্ষম তেলাপিয়া মজুদ করা যেতে পারে।
২. প্রজননক্ষম মাছ প্রতিপালন :
প্রজনন পুকুর তৈরি করার পর পরই নিকটবর্তী কোনো সরকারি বা বেসরকারি মৎস্য খামার থেকে উন্নত জাতের ১০-১২ সেন্টিমিটার আকারের ৬০-১০০ গ্রাম ওজনের সুস্থ সবল নাইলোটিকা মাছ সংগ্রহ করে প্রজনন পুকুরে মজুদ করতে হবে। পুকুরে মজুদের আগে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ শনাক্ত করে যথাক্রমে ৩ : ১ অনুপাতে শতাংশ প্রতি ৮০-১০০টি মাছ ছাড়তে হবে। অর্থাৎ ৮০টি মাছের মধ্যে ৬০টি স্ত্রী মাছ এবং ২০টি পুরুষ হতে হবে। যেহেতু মাছগুলো প্রায় ১০০ গ্রাম ওজনের তাই প্রজননকালে পরিপক্ক পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে তাদের জননেন্দ্রিয় দেখে সহজেই চেনা যায়।

সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ :
পুকুরে প্রজননক্ষম মাছ ছাড়ার পরদিন থেকেই সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। পুকুরে মজুদকৃত মাছের ওজনের ৫% হারে সম্পূরক খাদ্য সকালে এবং বিকেলে একই জায়গায় সরবরাহ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে চালের কুঁড়া ৫০% এবং সরিষার খৈল ৫০% একসাথে মিশিয়ে শুষ্ক অবস্থায় পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রতি সপ্তাহে জাল টেনে কিছু মাছ ধরে তাদের গড় ওজন বের করতে হবে এবং তার ওপর ভিত্তি করে মাছের খাদ্যের পরিমাণ পুনঃ নির্ধারণ করতে হবে ।
প্রজনন পুকুরে মাছ মজুদ করার ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই স্ত্রী মাছ ডিম থেকে রেনুপোনা ফুটায় বলে পুকুরের কিনারে ছোট রেণুপোনা ঝাঁক দেখা যায়। তখন প্রতিদিন মশারি কাপড়ের তৈরি জাল দিয়ে সকালে ও বিকেলে রেণুপোনাগুলো ধরে আঁতুড় পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।
আঁতুড় পুকুরে রেণু প্রতিপালন :
প্রজনন পুকুরের মতো আঁতুড় পুকুরও তৈরি করে নিতে হবে। আঁতুড় পুকুর আয়তনে ছোট এবং কম গভীর হলে রেনুপোনার জন্য ভালো হয় । সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ এবং গভীরতা
৩ ফুট হলেই চলে। পুকুর প্রস্তুতির পরে পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপন্ন হলে শতাংশ প্রতি ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০টি রেনুপোনা মজুদ করা যায়। আঁতড় পুকুরে ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত পোনা প্রতিপালন করা হয়।
এ সময় রেনুপোনার দৈহিক ওজনের ১২% হারে সম্পূরক খাদ্য দিনে তিন-চার বার প্রয়োগ করা হয়। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ৭০% চালের কুঁড়া এবং ৩০% খৈল একসাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে । খৈল চূর্ণ করে কুঁড়ার সাথে মিশিয়ে শুকনো খাদ্য পুকুরে ছড়িয়ে দিলে তেলাপিয়া পোনা দ্রুত খাদ্য খেয়ে ফেলে। এভাবে পরিচর্যার ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই পোনাগুলো যখন ২-৩ সে.মি. বা ১ গ্রাম ওজনের হয় তখন পোনাগুলোর মধ্যে থেকে বাছাই করে বড় আকারের পোনা লালন পুকুরে স্থানান্তর করতে হয়। নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করতে পারলে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই তেলাপিয়া লালন পুকুরে মজুদ উপযোগী হয়ে থাকে। লালন
পুকুরে পোনা প্রতিপালন :
লালন পুকুর ছোট আকারের অর্থাৎ ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে হলে ভালো হয়। লালন পুকুরও প্রজনন পুকুরের মতো যথারীতি প্রস্তুত করে পোনা মজুদের উপযোগী করে নিতে হবে। আঁতুড় পুকুর হতে বাছাইকৃত সুস্থ ও সবল পোনা শতাংশ প্রতি ১০০০-১২০০টি মজুদ করা যায়। পোনা মজুদের দিন হতে মাছের শরীরের ওজনের ১০% হারে সম্পূরক খাদ্য দিনে ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে প্রদত্ত খাদ্যের সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা অর্থাৎ প্রদত্ত খাদ্য মাছ সবটুকু গ্রহণ করছে কি না ।
মাছ সবটুকু খাদ্য গ্রহণ না করলে অর্থ এবং খাদ্য দুটোর অপচয় হয়। এবং পরিশেষে পানি দূষিত হয়ে মাছের মড়ক দেখা দেবে। সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য সপ্তাহে একবার জাল টেনে মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মোট জীবভর হিসেব করে প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এভাবে প্রায় ২ মাস পালনের পর যখন প্রতিটি পোনা প্রায় ১২-১৫ গ্রাম ওজনের হবে। তখন তাদের মধ্য থেকে একই আকারের বড় বড় সবল মাছগুলো বেছে নিয়ে মজুদ পুকুরে চাষ করার জন্য স্থানান্তর করতে হবে।
মজুদ পুকুরে নাইলোটিকা প্রতিপালন :
উন্নত চাষ পদ্ধতিতে তেলাপিয়ার জন্য কয়েকটি মজুদ পুকুর থাকলে ভালো হয়ে । সাধারণত আদর্শ খামারের জন্য আঁতুড় পুকুর, লালন পুকুর এবং মজুদ পুকুরের অনুপাত ১ : ৫ : ১০ হলে ভালো হয় অর্থাৎ ১ শতাংশ আঁতুড় পুকুর হলে ৫ শতাংশ লালন পুকুর এবং ১০ শতাংশ মজুদ পুকুর দরকার হয়। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মজুদ পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ২-৩ ফুট হলে ভালো হয় । পুকুর প্রস্তুত প্রণালি প্রজনন পুকুরের মতোই। পুকুর প্রস্তুতির পর শতাংশ প্রতি ৮০-১০০টি পোনা মজুদ করা যায়।
পোনা মজুদের পরে পুকুরে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে মাছের দৈহিক ওজনের শতকরা ৫ ভাগ হারে দিনে ২ বার সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্যের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য ১৫ দিন পর পর শতাংশ প্রতি ২ কেজি গোবর কিংবা ৫ কেজি কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ করতে হবে।
এভাবে ৫ থেকে ৬ মাস প্রতিপালনের পর যখন প্রতিটি মাছের গড় ওজন প্রায় ১৫০-২০০ গ্রাম হবে তখন মাছগুলো বিক্রয়যোগ্য হবে। অর্থাৎ ৫-৬ মাসের মধ্যে প্রতি শতাংশে ১৫-২০ কেজি মাছ উৎপন্ন হবে। অনেক সময় মজুদ পুকুরে পোনা মজুদের তৃতীয় মাসের পর হতে পুকুরের কিনারে রেণুপোনার ঝাঁক দেখা যেতে পারে।
আরও দেখুনঃ