ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি | অধ্যায়-৮ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি । যা ” সমন্বিত চিংড়ি চাষ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।

শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি

 

ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি | অধ্যায়-৮ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশের স্বাদু পানি অঞ্চলের হাওর এলাকা ও অতি নিচু এলাকার বোরো ধানের ক্ষেতে এবং মাঝারি নিচু এলাকার আমন ধান ক্ষেতে একই সঙ্গে ধান ও গলদা চিংড়ির চাষ করা যায়। এছাড়া যেসব ধানি জমিতে ৫-৬ মাস বন্যার পানি থাকে সেখানে বোরো ধানের পর গলদা চিংড়ির চাষ করা যায়। অর্থাৎ একই জমিতে (১) খানের সাথে চিংড়ি চাষ এবং (২) ধানের পর চিংড়ি চাষ এই দুই পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষ করা যায়।

ধানের সাথে চিংড়ি চাষ

এই পদ্ধতিতে ধান ও চিংড়ি চাষ একই সাথে করা হয়। এখানে ধান আসল ফসল এবং চিংড়ি অতিরিক্ত ফসল হিসেবে বিবেচিত। ধানের সাথে চিংড়ি চাষ পদ্ধতিতে যেসব কাজ করতে হয় সেগুলোকে প্রধানত চারটি অংশে ভাগ করা যায়, যথা

(ক) জমি প্রস্তুতকরণ। (খ) মাটি কর্ষণ ও সার প্রয়োগ (গ) ধানের চাষ (ঘ) চিংড়ির চাষ

(ক) জমি প্রস্তুতকরণ

এসব ক্ষেত এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যাতে একই সময়ে একই জমিতে ধান ও চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। চিংড়ির জন্য ক্ষেতে কমবেশি পানি থাকতেই হবে, যেন পানি একেবারে শুকিয়ে গিয়ে চিংড়ি মারা না যায়। আবার লক্ষ্য রাখতে হবে যেন অতিরিক্ত পানিতে ধান গাছগুলো ডুবে না যায় বা ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি জমির আইলের ওপর দিয়ে উপচে বেরিয়ে চলে না যায়।

অপর দিকে, খরার সময় ক্ষেতে পানি বেশ কিছুটা শুকিয়ে গেলেও যেন ক্ষেতের কোনো স্থানে জমা করা পানিতে চিংড়ি আশ্রয় নিতে পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাছাড়া ক্ষেত থেকে অতিরিক্ত পানি নির্গমনের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং এই নির্গমন পথ দিয়ে চিংড়ি যাতে বের হয়ে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণত ধান ক্ষেতকে চিংড়ি চাষের উপযোগী করে তোলার জন্য জমি প্রস্তুতির সমগ্র কাজগুলোকে ৫টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

এই কাজগুলো নিম্নরূপ:

(১) ক্ষেকের চার পাশে আইল বা বাঁধ নির্মাণ

(২) ক্ষেতের ভেতরে পরিখা খনন

(৩) ক্ষেতের অভ্যন্তরে গর্ত বা খাল খনন

(৪) পানি প্রবেশ ও নির্গমনের নালা তৈরিকরণ

(৫) নালার মুখে জাল স্থাপন।

(১) আইল বা বাঁধ নির্মাণ

জমির চারপাশের আইল উঁচু ও শক্ত করে বাঁধতে হবে যাতে চিংড়ি বের হয়ে যেতে না পারে। আইলের উচ্চতা কমপক্ষে ৬০ সেমি হতে হবে যাতে জমিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি ধরে রাখা যায়। মাটি এঁটেল ও দোআঁশ হলে আইলের গোড়া প্রশস্ত হবে ৫০ সেমি এবং উপরের দিকে প্রশস্ত হবে ৩০ সেমি। মাটি দোজাঁশ বা বেলে দোঁআশ হলে আইলের প্রশস্ততা আরও বেশি হতে হবে।

(২) পরিখা খনন

আইলের ভেতর জমির সমতা বা ঢাল অনুসারে চারপাশে, দুই পাশে অথবা আড়াআড়িভাবে পরিখা বা পর্দমা খণল করতে হবে। এই পর্দমায় গ্রন্থ প্রায় ৭৫ গেমি ও গভীরতা প্রায় ৫০ সেমি হলে ভালো হয়। তবে নর্দমার দৈর্ঘ্য জমির অনুপাতে হবে। ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে চিংড়ির অবাধ চলাচলের জন্য এই নর্দমার প্রয়োজন। এছাড়া কীটনাশক প্রয়োগের সময় এবং ক্ষেতের পানি কমে গেলে চিংড়ি এই নর্দমায় আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।

(৩) গর্ত বা খাল খনন, পানি প্রবেশ ও নির্গমনের নালা তৈরিকরণ

পরিখাগুলোর সংযোগস্থলে কিংবা জমির নিচু অংশে গর্ত খনন করতে হবে। এই গর্তের গভীরতা ৬০ সেমি হলে ভালো হয়। আইল থেকে কমপক্ষে ১২০ সেমি দূরে পরিখা ও গর্ত খনন করতে হবে। এই পরিখা ও গর্তের আয়তন জমির মোট আয়তনের ০.৫% হলে ভালো হয়। বর্ষার সময় যাতে ক্ষেত থেকে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে, সেজন্য আইলের কোনো স্থানে এক বা একাধিক নির্গমন নালা রাখতে হবে। এ কাজে বাঁশের চোঙ ব্যবহার করা যেতে পারে। এই নালা বা বাঁশের চোঙ আইলে ৩৫ সেমি উচ্চতায় রাখলে ক্ষেতের অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যাওয়ার পরও প্রয়োজনীয় পানি ক্ষেতে থেকে যাবে।

(৪) তারের জাল বা বাঁশের বানা স্থাপন

নালা বা চোড়ের মুখে তারের জাল অথবা বাঁশের বানা লাগিয়ে দিতে হবে যাতে পানির সাথে চিংড়ি বের হয়ে যেতে না পারে।

(খ) মাটি কর্ষণ ও সার প্রয়োগ

মাটি কর্ষণ

ধান চাষের জমি যেভাবে চাষ করা ঠিক সেভাবে জমিতে চাষ ও মই দিয়ে এবং আগাছামুক্ত করে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে। জমি যতটুকু সম্ভব সমান বা সমতল করতে হবে। যাতে ক্ষেরের সর্বত্র পানির গভীরতা সমান থাকে।

ধানের জাতের ওপর নির্ভর করে জমিতে সার প্রয়োগ করা হয়। যেসব ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষ করা হয় সাধারণত সেসব জমিতে আধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করা হয়। স্বাভাবিকভাবে আধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষের জন্য অনুমোদিত সার প্রয়োগের মাত্রার সাথে চিংড়ি চাষের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ হারে অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা হয়।

ইউরিয়া সার ছাড়া অন্যান্য সার জমির শেষ চাষের সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। জমি শেষ চাষের পর মাটি কাদা করার সময়ে সার ঘাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার সমান তিনভাগ করে তিন কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে ধান রোপণের ১৫, ৩০ ও ৫৫ দিন পর এই সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি প্রয়োপের পূর্বে ক্ষেতের পানি এমন পরিমাণে কমাতে হবে যাতে উপরি সার প্রয়োগ সময়ে চিংড়ি ও মাছ পরিখা গর্তের পানিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে।

(গ) ধান চাষ

জাত নির্বাচন

আধুনিক জাতের, খাটো ও খাড়া এবং সহজে হেলে পড়ে না এমন জাতের ধান চাষ করার জন্য নির্বাচন করা উচিত। এরকম জাতের ধান গাছের ভিতর দিয়ে চিংড়ি সহজেই চলাচল করতে পারে এবং পানিতে সহজেই রোদ পড়তে পারে। ফলে মাছের ও চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন হতে পারে। তবে ধানের জাতটি এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে যেন তা উৎপাদন মৌসুম উপযোগী হয়। এসব জমিতে চাষের জন্য যেসব জাত উপযুক্ত সেগুলোর মধ্যে বিআর-১১ (মুক্তা), বিজ্ঞার-৩ (বিসব) ও বিআর-১৪ (গাজী) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চারা রোপণ

ক্ষেতে কমপক্ষে এক মাস বয়সের চারা রোপণ করলে ধানের ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়। ধানের চারা ক্ষেতে সারিবদ্ধ লাইন করে লাগাতে হয়। এক লাইন থেকে অপর লাইনের দূরত্ব প্রায় ১৫ সেমি হয়ে থাকে। এভাবে ৩/৪ টি চারাযুক্ত গোচাগুলো রোপণ করা যায়। তবে চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে সারিগুলো জোড়ায় জোড়ায় স্থাপন করা যায়। জোড়া সারির মধ্যে দূরত্ব হবে প্রায় ১৫ সেমি এবং পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যালোক পড়তে পারে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যা চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিচর্যা

ধান ক্ষেতের বিভিন্ন পরিচর্যা, যেমন-আগাছা পরিষ্কার, ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগে, পর্যায়ক্রমে জমি শুকানো ও ভিজানো ইত্যাদি কাজগুলো প্রচলিত পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। সারের উপরি প্রয়োগের সময় যেন পরিখায় ও গর্তে পানি থাকে এবং জমিতে বেশি পানি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

(ঘ) চিংড়ি চাষ

প্রজাতি নির্বাচন

বাংলাদেশে স্বাদু বা মিঠা পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়, তবে এদের সবগুলোই চাষযোগ্য বা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। ধানক্ষেতে চাষের জন্য এমন প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে যা চাষযে- াগ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হয়। এসব বিচারে গলদা চিংড়ি ধান ক্ষেতে চাষের জন্য উপযুক্ত। কারণ দেশে ও বিদেশে গলদা চিংড়ির প্রচুর চাহিদা রয়েছে, এরা দ্রুত বর্ধনশীল এবং অধিক তাপমাত্রা সহনশীল। সর্বোপরি দেশের সব জলাশয়ে গলদা চিংড়ি চাষ করা যায় এবং সারা বছর এর পোনা পাওয়া যায়।

ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষের জন্য প্রকৃতপক্ষে ৩-৪ মাস সময় পাওয়া যায়। কাজেই এই অল্প সময়ে চাষ করে চিংড়ি বাজারজাত করতে হলে অবশ্যই বড় আকারের পোনা ধানক্ষেতে মজুদ করতে হবে। নতুবা চিংড়ি চাষ অলাভজনক হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

ধানক্ষেতে কমপক্ষে ৫ সেমি আকারের পোনা মজুদ করা ভালো। বড় আকারের পোনা মজুদ করলে ৩-৪ মাসের মধ্যে এদের বাজারজাত করা সম্ভব। এ সময়ে এদের গড় ওজন প্রায় ৩৫ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। জোয়ারভাটা হয় এমন নদনদীতে প্রায় সারা বছরই গলদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়।

হাওর এলাকায় নদীগুলোতে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ও আশ্বিন কার্তিক মাসে এই পোনা অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়া দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক গলদা হ্যাচারি গড়ে ওঠেছে। এসব হ্যাচারি থেকেও গলদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

মঞ্জুদের হার নির্ধারণ

ধানক্ষেতে হেক্টর প্রতি ৫ সেমি আকারের ১০-১৫ হাজার পোনা মজুদের হার নির্ধারণ করা হয়।

পোনা ছাড়ার নিয়ম

ক্ষেতে ধানের চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর চিংড়ির পোনা মজুদ করা উচিত। চারা রোপণের পর জমিতে চারা লেগে গিয়ে বেশ কিছুটা বেড়েছে এমন পর্যায়ে চিংড়ির পানা মজুদ করতে হবে। ধানের চারা রোপণের পূর্বে চিংড়ির পোনা মজুদ করা ঠিক নয়। এতে পানার ব্যাপক মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

জমিতে পোনা ছাড়ার সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে সকাল বেলা ও বিকাল বেলা। পোনা পরিবহন পাত্রের পানির তাপমাত্রা এবং ধানক্ষেতের পানির তাপমাত্রার মধ্যে সমতা এনে পোনা মজুদ করতে হবে। কারণ পানির তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনে চিংড়ি পোনার ব্যাপক মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

চিংড়ি পরিচর্যা

কোন বাড়তি খাবার প্রয়োগ না করেও ধানক্ষেত্রে চিংড়ি চাষ করা যায়। ধান ক্ষেতের শেওলা, পোকামাকড় ও পচনশীল দ্রব্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে অর্থাৎ ধানক্ষেতে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়েও চিংড়ি বড় হতে পারে। তবে কিছু খাবার প্রয়োগ করলে চিংড়ির বাড়তি উৎপাদন পাওয়া যায়।

চিংড়ি চাষের শুরু থেকেই ১০ কেজি পরিমাণ চালের কুঁড়া ও গোবর ১৪৩ অনুপাতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর পরিখা ও গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। চিংড়ি ছাড়ার মাস খানেক পর থেকে মোট চিংড়ির আনুমানিক ওজনের ৩ ৫% হারে খৈল ও ভুষি বা কুঁড়া ১৪১ অনুপাতে মিশিয়ে একদিন পর পর পরিখা ও গর্তে প্রয়োগ করতে হবে।

খাদ্য হিসেবে খৈল ব্যবহ- ারের আগে একরাত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর এই ভেজা খৈল, ভুষি বা চালের কুঁড়ার সাথে মিশিয়ে বল আকারে বিকাল বেলায় ক্ষেতের পরিখার ও গর্তের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োগ করতে হবে।

পানি ব্যবস্থাপনা

চিংড়ির পোনা মজুদের পর জমিতে সব সময়েই পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম দিকে ক্ষেতের ওপর ১০-১৫ সেমি গভীর পানি থাকলেই চলে, তবে পানির গভীরতা ধান ও চিংড়ির বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি করতে হবে। শেষের দিকে এই গভীরতা ৩০-৩৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে।

ধানক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা ও সার প্রয়োগের জন্য পানি কমাতে হলে চিংড়িগুলোকে পরিখা ও গর্তের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি আস্তে আস্তে কমালেই চিংড়ি পরিখা ও গর্তের পানির মধ্যে আশ্রয় নিবে। অতিবৃষ্টি কিংবা অন্য কোনো কারণে ক্ষেতের পানি দ্রুত বেড়ে গেলে নির্গমন নালা বা ড্রেন ও চোছের মধ্য দিয়ে পানি নিষ্কাশন করতে হবে।

চিংড়ি আহরণ

ধান পাকা শুরু হলে ক্ষেতের পানি ধীরে ধীরে কমিয়ে চিংড়িগুলোকে পরিখা ও গর্তে আনতে হবে। তারপর ধান কাটা শেষ করে চিংড়ি ধরতে হবে। হাত জাল, ঝাকি জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাদ দিয়ে চিংড়ি ধরা যায়। কোনো কারণে ধান পাকার আগেই জমির পানি শুকাতে শুরু করলে, ধান কাটার আগেই চিংড়ি ধরা যায়।

তবে চিংড়ি বাজারজাত করার উপযোগী না হলে এবং ক্ষেতে রাখার সুযোগ থাকলে, চিংড়ি না ধরে ধান কাটার পরও ক্ষেতে রেখে বড় করা যায়। এরূপ অবস্থায় পাম্প মেশিনের সাহায্যে বা অন্য কোনো উৎস থেকে ক্ষেতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওর এলাকায় বোরো ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ করলে, বাড়তি খাবার ছাড়াই এর উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ২৮০ কেজি হয়। তবে খাবার প্রয়োগ করে চিংড়ির উৎপাদন ৪০০ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। আমন ধান ক্ষেতে শুধু প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে হেক্টর প্রতি ১০০-১৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। পক্ষান্তরে ধানক্ষেতে বাড়তি খাবার প্রয়োগ করে হেক্টর প্রতি ২০০-৩০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব।

ধানের পর চিংড়ি চাষ

খানের পর চিংড়ি চাষ পদ্ধতিকে ধান-চিংড়ির পর্যায়ক্রমিক চাষ পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে একই জমিতে। ধান ও চিংড়ি পর্যায়ক্রমে চাষ করা হয়। সাধারণত এই চাষ পদ্ধতিতে কোনো জমিতে ধান উৎপাদনের পরে সেখানে চিংড়ি চাষ করা হয়। চিংড়ি উৎপাদনের পর সেখানে আবার ধান চাষ করা হয়।

বোরো ধান কাটার পর যেসব এলাকা পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে এমন জায়গায় চিংড়ি চাষ করা যায়। সাধারণত এসব জমি উঁচু আইল কিংবা জমি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। বাংলাদেশের বৃহত্তম ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার নিচু জমিগুলোতে এ পদ্ধতিতে ধান চাষের পর চিংড়ি চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

ধানের পর চিংড়ি চাষ পদ্ধতির কিছু কিছু অংশের ধানের সাথে চাষ পদ্ধতির সাথে মিল আছে। তবে যেসব বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে এখানে তা বর্ণনা করা হলো। সম্পূর্ণ কাজগুলোকে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যায়, যথা

(ক) জমি প্রস্তুতকরণ

(খ) ধানের চাষ

(গ) চিংড়ি চাষ

(ক) জমি প্রস্তুতকরণ

আইল বা বাঁধ নির্মাণ

চিংড়ি চাষের জন্য এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে জমির চারপাশে আইল বা উঁচু জমি আছে যা বন্যার পানিতে ডুবে না। জমির চারপাশে আইল বা উঁচু জমি না থাকলে, সেখানে আইল বা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। জমির আইল ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে। চিংড়ি চাষকালে জমিতে প্রচুর পানি থাকে, আবার চিংড়ির সাথে খান থাকে না বলে এসব জমিতে পরিখা বা গর্ত খনন না করলেও চলে। তবে চিংড়ি আহরণের সুবিধার্থে জমির নিচু স্থানে স্বল্প ব্যয়ে গর্ত তৈরি করা যায়।

নির্গমন নালা তৈরি

বর্ষার অতিরিক্ত পানি জমি থেকে সহজে বের করার জন্য নির্গমন নালা বা ড্রেন খনন করা দরকার। জমির আকার, আয়তন ও পানির গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্গমন নালার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্গমণ নালা এমনভাবে খনন করতে হবে এবং নালার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে যাতে জমিতে পানির গভীরতা ১.২৫ মিটারের বেশি না হয়।

তারের জাল বা বাঁশের বালা স্থাপন

নির্গমন নালাগুলোর মুখে মোটা তারের জাল বা বাঁশের তৈরি শক্ত বানা স্থাপন করতে হবে, যাতে পানি নির্গমা নর সময় পানির সাথে চিংড়ি চলে যেতে না পারে।

সার প্রয়োগ

ধানের জন্য অনুমোদিত সারগুলো ধান চাষেই ব্যবহার করতে হবে। চিংড়ি চাষের জন্য অতিরিক্ত ১৫% হারে সার চিংড়ি চাষকালে প্রয়োগ করতে হবে।

(খ) ধান চাষ

জাত নির্বাচন

চাষের এলাকা অনুযায়ী আধুনিক জাতের বা দেশি জাতের যে কোনো ভালো জাতের ধান আবাদ করা যায়।

ধানের মৌসুম

বোরো ধানের স্বাভাবিক সময়ই সাধারণত এই ধান চাষের মৌসুম। সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি বা পৌষ-মাঘ মাসে বোরো ধানের চারা রোপণ করা হয় এবং এপ্রিল-মে বা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে ফসল কাটা হয়।

চারা রোপণ ও পরিচর্যা

এই পদ্ধতিতে চিংড়ি এককভাবে চাষ করা হয় বলে ধান চাষের জন্য ভিন্নতর কোনো উপায়ে ধানের পরিচর্যা করার প্রয়াজন হয় না। তাই ধানের চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, আগাছা দমন ও অন্যান্য পরিচর্যা প্রচলিত উন্নত পদ্ধতিতে করলেই হবে।

ধান কাটা

ধান এমনভাবে কাটতে হবে যাতে ক্ষেতে যথেষ্ট পরিমাণে ধান গাছের গোড়া বা নাড়া থেকে যায়। পরবর্তীতে এই নাড়া পড়ে চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়।

(গ) চিংড়ি চাষ

প্রজাতি নির্বাচন

চিংড়ি চাষের জন্য মিঠা পানির গলদা চিংড়ি চাষ করা সবচেয়ে ভালো ও লাভজনক। তবে মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে চিংড়ির সাথে রাজপুঁটি ও রুইজাতীয় মাছের চাষ করা যায়।

চিংড়ির পরিচর্যা

ধান চাষের পর চিংড়ি চাষে কোনো বাড়তি খাদ্য প্রয়োগ না করেও চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। তবে খাবার প্রয়োগের ফলে চিংড়ি ও মাছের দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুততর হয় এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন প্রতি হেক্টরে ১০ কেজি পরিমাণ কুঁড়া ও গোবর ১:৩ অনুপাতে মিশিয়ে খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করা যায়।

 

ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি | অধ্যায়-৮ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

চিংড়ি আহরণ

বর্ষা শেষে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জমির পানি কমে গেলে চিংড়ি ধরে ফেলতে হবে। তবে পানি এ সময়ের আগে শুকালে চিংড়ি ও মাছ ধরে ফেলাই উত্তম। এই পদ্ধতিতে এককভাবে গলদা চিংড়ি চাষ করলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৫০০ কেজি এবং মিশ্র চাষে হেক্টরপ্রতি ১৫০-২০০ কেজি চিংড়ি ও ৪০০-৫০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যেতে পারে।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ডিসেম্বরের মাঝামঝি থেকে জানুয়ারি মাসের শেষ সময় পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের জন্য জমি প্রস্তুত করা হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় এ সময়ের কিছুটা হেরফের হতে পারে। সাধারণত বেড়ি বাঁধের মধ্যে চিংড়ি ও লবণ চাষ করা হয়। চিংড়ি ও লবণ চাষের জমিকে প্রথমত ৬-৭টি প্রকোষ্ঠগুলোর নির্দিষ্ট কোনো আয়তন নেই।

তবে সচরাচর প্রত্যেকটি প্রকোষ্ঠের আয়তন সমান থাকে। আবার প্রকোষ্ঠগুলোর আয়তন ছোট বা বড়ও হতে পারে। ১-১.৫ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে প্রকোষ্ঠগুলো ছোট নালা দ্বারা একটির সাথে অন্যটির সংযোগ রক্ষা করা হয়। লবণ চাষের জন্য এই প্রকোষ্ঠগুলোর তলা রোলারের সাহায্যে শরু করা হয়।

প্রকোষ্ঠগুলোর আইল বা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে সরবরাহ নালা থেকে জলাধারে লোনা পানি কয়েকদিন রাখা হয়। তারপর জলাধার থেকে লোনা পানি প্রথম প্রকোষ্ঠে ঢুকানো হয়। তারপর এই পানি ১৫-২০ দিন রৌদ্রে বাষ্পীয়করণ করার পর ছোট নালা দিয়ে দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে ঢুকানো হয়। এভাবে এই বাষ্পীভূত পানি পর্যায়ক্রমে শেষে বা সপ্তম প্রকোষ্ঠে আনা হয়। এই প্রকোষ্ঠেই লোনা পানি ১-২ সপ্তাহ বাষ্পীভূত পানি পর্যায়ক্রমে শেষ বা সপ্তম প্রকোষ্ঠে আনা হয়।

এই প্রকোষ্ঠেই লোনা পানি ১-২ সপ্তাহ বাষ্পীভূত করে লবণ সংগ্রহ করা হয়। এইভাবে প্রথম প্রকোষ্ঠের পানি দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করানোর পর আবার নতুন পানি প্রথম প্রকোষ্ঠে ঢুকানো হয় এবং পর্যায়ক্রমে বাষ্পীয়করণের মাধ্যমে এই বাষ্পীভূত পানি প্রত্যেকটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে দিয়ে এসে শেষ সপ্তম প্রকোষ্ঠ আসে এবং এখান থেকেই চূড়ান্তভাবে লবণ সংগ্রহ করা হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment