আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় থাই সরপুঁটি বা রাজপুঁটির চাষ – যা মৌসুমি পুকুরে মাছচাষ এর অন্তর্ভুক্ত।
থাই সরপুঁটি বা রাজপুঁটির চাষ
আমাদের দেশে ১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে এ মাছ আমদানি করা হয় বলে একে থাই সরপুঁটি বলা হয়। আবার অনেকে এ মাছকে রাজপুঁটি নামেও অভিহিত করে থাকেন। থাই সরপুঁটি দেখতে অনেকটা দেশী সরপুঁটির মতো। তবে থাই সরপুঁটি দেশী সরপুঁটির চেয়ে উজ্জ্বল, বেশি প্রশস্ত। নিচে মৌসুমী পুকুরে থাই সরপুঁটি চাষের সুবিধা সমূহ বর্ণনা করা হলো ।
থাই সরপুঁটি চাষের সুবিধা সমূহ-
- মাছটি দ্রুত বর্ধনশীল, সুস্বাদু তাই বাজারে বেশ চাহিদা আছে;
- যেকোন আকারের ছোট-বড় ডোবা, পুকুর দিঘি ও অন্যান্য পরিত্যক্ত জলাশয়ে এ মাছ চাষ করা যায়;
- প্রতিকূল পরিবেশে তুলনামূলকভাবে কম অক্সিজেন ও বেশি তাপমাত্রায়ও এ মাছ বাঁচতে পারে;
- ঘোলা পানির পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়;
- মাছটির বর্ণ আকর্ষণীয় উজ্জ্বল রূপালী সাদা এবং এটি একটি শক্ত গড়নের মাছ ফলে সহজেই রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না;
- সব ধরনের প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে অত্যন্ত। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ, যেমন- ক্ষুদিপানা, সুজিপানা প্রভৃতি এদের প্রিয় খাদ্য। সম্পূরক বা বাড়তি খাদ্য খেতে এ মাছ খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করে,
- সম্পূরক খাদ্য হিসেবে শুধুমাত্র চালের কুঁড়া ব্যবহার করেই এ মাছটির ভাল ফলন পাওয়া যায়, ৬-৭ মাস পানি থাকে এমন জলাশয়ে খুব সহজেই এ মাছ চাষ করা যায়। কারণ এরা ৬-৭ মাসেই
- ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের হয় এবং বাজারজাত করা যায়;
- অপেক্ষাকৃত কম খরচে ও সহজ ব্যবস্থাপনার অল্প সময়ে এ মাছটির অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়,
- একক বা মিশ্ৰ উভয় পদ্ধতিতে এ প্রজাতির মাছচাষ করা যায়। তবে মিশ্রচাষের চেয়ে একক পদ্ধতিতে এ মাছচাষ উত্তম। এতে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়;
- একই পুকুরে বছরে দু’বার চাষ করা যায় ও
- হ্যাচারিতে অতি সহজেই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় ।
রাজপুঁটির শারীরিক গঠন :
রাজপুঁটির দেহের বর্ণ উজ্জ্বল রূপালী এবং লেজ খাঁজ কাটা। পায়ু ও প্রোণী পাখনার রং রক্তিম গোলাপি, বক্ষ পাখনার রং হালকা হলুদাভ ও অনেকটা বিবর্ণ। পৃষ্ঠদেশ কিছুটা প্রশস্ত। মুখ গহ্বরে তিন সারি দাঁত বিদ্যমান। এ মাছটির কোন পাকস্থলী নেই। অন্ননালীর মধ্যেই এদের খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অন্ননালীর দৈর্ঘ্য শরীরের দৈর্ঘ্যের দুই-তিন গুণ লম্বা হয়ে থাকে। এদের দেহ গোলাকার আঁইশ যারা আবৃত। সাধারণ ব্যবস্থাপনার এক বছরে খাই সরপুঁটি সাধারণত ২৫০-৪০০ গ্রাম ওজনের হরে থাকে। তবে সর্বোচ্চ এরা ১.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

রাজপুঁটির চাষ পদ্ধতি :
সঠিকভাবে পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতির ওপর মাছচাষের সফলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই মাছচাষে সফলতা পেতে হলে সঠিকভাবে পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। উক্ত কার্যক্রম কিভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে নিচে তার বর্ণনা দেয়া হলো।
পুকুর নির্বাচন :
সারা বছর পানি থাকে অথবা মৌসুমী পুকুর এ দু’ধরনের পুকুরেই সরপুঁটি চাষ করা যায়। পুকুরের আয়তন ১-৩ বিঘা এর মধ্যে হলেই ভালো হয়। তবে এর চেয়ে বড় বা ছোট আকারের পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায়। পুকুরটি আগাছামুক্ত ও খোলামেলা এবং বন্যামুক্ত স্থানে হওয়াই বাঘনীর।
পুকুরের গভীরতা ৩-৫ ফুট হলে ভালো হয়। পুকুর পাড়ে বড় ধরনের গাছপালা এবং গাছের পাতা পানিতে পড়তে পারে এ জাতীয় পাছ না থাকাই ভালো। পুকুরের পানির উপর গাছের ছায়া পড়লে পুকুরে সূর্যালোকের অভাবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মাতে পারে না। তদুপরি গাছের পাতা পানিতে পচে পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ বিনষ্ট করা সহ উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। সাধারণত দোঁ-আশ ও কাদাযুক্ত দোঁ-আশ মাটি পুকুরের জন্য উত্তম। মাছচাষ ব্যবস্থাপনার জন্য পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উচিত। সার্বিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে পুকুরের অবস্থান বসতবাড়ির নিকটে হওয়া ভালো।
পুকুর প্রস্তুতি :
পোনা মজুদের পূর্বে অবশ্যই ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাছের শারীরিক বৃদ্ধির স্বার্থে পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। পুকুর প্রস্তুতির বিভিন্ন পর্যায়গুলো ধারাবাহিকভাবে নিচে বর্ণনা করা হলো। যেমন- জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ, রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ, চুন ও সার প্রয়োগ ইত্যাদি।

জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ :
পুকুরে কোনো প্রকার জলজ আগাছা থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জলজ আগাছা পুকুরের পুষ্টি শোষণ করে এবং পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা প্রদান করে ও জলজ কীটপতঙ্গসহ রোগজীবাণুর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই পুকুর হতে সকল প্রকার জলজ আগাছা দূর করতে হবে। তবে সরপুঁটি মাছ উদ্ভিদ ভোজী স্বভাবের হওয়ায় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, যেমন- ক্ষুদিপানা, সুজিপানা, নরম ঘাস ইত্যাদি রাখা যেতে পারে।
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ :
জলজ আগাছা দূরীকরণের পর পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করতে হবে। রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ আমরা বিভিন্নভাবে দূর করতে পারি। যেমন- পানি শুকিয়ে, ঘন ঘন জাল টেনে, মাছ মারার ঔষধ (বিষ) প্রয়োগ করে ইত্যাদি। রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণের পর পুকুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুন প্রয়োগ :
পুকুরের পানিকে মাছের বসবাসের জন্য পরিবেশ উপযোগী এবং মাছকে রোগমুক্ত রাখতে মাছচাষের পুকুরে অবশ্যই নিয়মিতভাবে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে যদি রোটেনন প্রয়োগ করা হয় তাহলে রোটেনন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর এবং টিএসপি সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন আগে শতাংশ প্রতি সাধারণত ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের নির্দিষ্ট বিরতির পর সার প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ :
মাছের খাদ্য তৈরিতে সহায়তা করার জন্য পুকুরে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সার প্রয়োগের ফলে পুকুরের পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা বৃদ্ধি পায় যা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চুন প্রয়োগের অন্তত ৫-৭ দিন পর নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত দু’ধরনের সার একত্রে একটি পাত্রে পানির সাথে ভালোভাবে গুলে সূর্যালোকিত দিনের প্রথম ভাগে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। টিএসপি সার ধীরে ধীরে গলে যায় বলে সার প্রয়োগের অন্তত ১২ ঘণ্টা পূর্বে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। আর ইউরিয়া সার সহজে গলে এবং উদ্বায়ী বলে পূর্বে ভিজিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। প্রয়োগকালীন সময়ে অন্যান্য সারের সাথে মিশিয়ে নিলেই চলবে। উল্লেখিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ৪-৫ দিনের মধ্যে পানির রঙ হালকা সবুজ বা লালচে সবুজ ধারণ করে যা প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ।
প্রাকৃতিক খাদ্য ও পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষাকরণ :
সার প্রয়োগের ৮-১০ দিন পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পরিমিত পরিমাণে তৈরি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে পোনা ছাড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। পানির রং দেখে অথবা স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে পানি নিয়ে প্ল্যাংকটনের উপস্থিতি লক্ষ্য করেও তা পরিমাপ করা যেতে পারে । ঘোলা পানিতে এ পরীক্ষায় সঠিক ফল পাওয়া যাবে না।
পানিতে বিষক্রিয়া থাকলে পোনা মারা যাবে বিধায় পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক কোনো পাত্রে পরিমাণমতো পানি নিয়ে তার মধ্যে ৫-৭টি পোনা রেখে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে অথবা পুকুরের পানিতে হাপা স্থাপন করে কিছু পোনা ছেড়ে অন্তত ২৪ ঘণ্টা রাখার পর পোনা মারা না গেলে পোনা ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। পোনা ছাড়ার আগের দিন পুকুরে ২-৩ বার হড়রা বা জাল টেনে নেয়া যেতে পারে। এতে করে তলদেশে জমা দূষিত গ্যাস দূর হবে।
পোনা মজুদ :
একক চাষের ক্ষেত্রে ২-৩ ইঞ্চি (৮-১০ গ্রাম ওজনের) আকারের পোনা নির্বাচন করাই উত্তম । ছোট আকারের পোনা মজুদে পোনা মৃত্যুর হার বেশি হয় এবং আশানুরূপ ফল লাভের সম্ভাবনা কম থাকে । পুকুরের পানিতে পরিমিত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য বিদ্যমান থাকলে শতাংশ প্রতি ৭০-৭৫টি চারা পোনা মজুদ করা যায়। আর মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে কাতলা, রুই, মৃগেল, সিলভার কার্প, মিরর কার্প প্রভৃতি মিলে ৩০-৪০টি পোনার সাথে শতাংশ প্রতি অতিরিক্ত ১০-১৫ সরপুঁটি মজুদ করা যেতে পারে।
পোনা অভ্যস্তকরণ ও পুকুরে ছাড়া :
পোনা মাছ সকালে বা বিকেলে পাড়ের কাছাকাছি ঠাণ্ডা পরিবেশে পুকুরে ছাড়াই উত্তম। অতি বৃষ্টিতে বা কড়া রোদের সময় পোনা ছাড়া উচিত নয়। পুকুরে পোনা বেঁচে থাকার হার বাড়ানোর জন্য পোনা টেকসই বা অভ্যস্তকরণ করে পরে পুকুরে ছাড়তে হবে। নিকটবর্তী স্থানের জন্য পোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে মাটির হাঁড়ি বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দূরবর্তী স্থানের জন্য অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহন করা অধিকতর নিরাপদ।
পুকুরে পোনা ছাড়ার সময় পোনাভর্তি ব্যাগ বা পাত্রের অর্ধাংশ পুকুরের পানিতে ১০-১৫ মিনিট ভাসিয়ে রাখতে হবে। এর পর ব্যাগ বা পাত্রের মুখ খুলে কাত করে ধরতে হবে অতঃপর পাত্র বা ব্যাগের কিছু পানি বের করে এবং পুকুরের পানি ভিতরে ঢুকিয়ে উভয় পানির তাপমাত্রা সমতায় আনতে হবে। যখন পাত্রের ভিতরের এবং পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমান হয়েছে বলে প্রতীয়মান হবে তখন ব্যাগ বা পাত্রটিকে কাত করলে পোনাগুলো আপনা-আপনি পুকুরে চলে যাবে
মজুদ পরবর্তী সার প্রয়োগ :
পুকুরে পোনা মজুদের পর প্রয়োজনমতো নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের জন্য সেকিডিস্ক পাঠ দেখে নিতে হবে। সেকিডিস্ক পাঠ ৩০ সে.মি. এর বেশি হলে সার প্রয়োগ করা উচিত এবং কম হলে সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। মজুদ পরবর্তী সময়ে ভালো ফল লাভের জন্য জৈব ও অজৈব সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ দিন অন্তর অন্তর পুকুরের পানির বর্ণ দেখে সার প্রয়োগের প্রয়োজন হলে শতাংশ প্রতি ১ কেজি গোবর অথবা ২ কেজি কম্পোস্ট সার, ২০ গ্রাম টিএসপি মিশিয়ে ৩ গুণ পানি দিয়ে একটি পাত্রে ১ রাত ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে।
পরের দিন সকালে প্রয়োগের আগে ৪০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে ভালো করে পানিতে গুলে নিয়ে প্রখর সূর্যালোকিত দিনে ১০-১১ টার মধ্যে সারা পুকুরে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, পুকুরের পানির বর্ণ যদি অত্যধিক সবুজ রঙ ধারণ করে তাহলে সার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। উল্লেখ্য, ঘোলা পানির কারণে সেকিডিস্ক পাঠ এ সঠিক তথ্য নাও পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আলোকেই সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয় করতে হবে।
পুকুরে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ :
পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয় বিধায় মাছের দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধির নিমিত্তে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা একান্ত প্রয়োজন । রাজপুঁটি মাছের জন্য মাছ ছাড়ার পর দিন হতে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে মোট মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজনের শতকরা ৫-৬ ভাগ হারে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, সরিষার খৈল, সবুজ উদ্ভিদ ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
কুঁড়া বা ভুসি এবং সরিষার খৈল সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে ৭৫% চালের কুঁড়া বা গমের ভুসির সাথে ২৫% সরিষার খৈল ব্যবহার করা যেতে পারে। সরিষার খৈল কমপক্ষে ১ রাত ২ গুণ পরিমাণ পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে ভেজা খৈলের সাথে কুঁড়া বা ভুসি মিশিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করে সকালে বা বিকেলে খাদ্যদানিতে প্রয়োগ করতে হবে। এ জাতীয় খাদ্য ছাড়াও রাজপুঁটি মাছের জন্য অনেক সময় ভাসমান খাদ্য হিসেবে শুধুমাত্র গমের ভুসি বা কুঁড়া শুকনো অবস্থায় পানির উপরে প্রয়োগ করেও ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে ক্ষুদিপানা,সুজিপানা, নরম ঘাস, যেমন- পারা, নেপিয়ার, কলাপাতা প্রভৃতি সরপুঁটি মাছ আগ্রহ সহকারে খেয়ে থাকে। এসব সবুজ ঘাস ও পানা পুকুরে স্থাপিত ‘ফিডিং রিং’ -এ সকালে বিকেলে দিতে পারলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়। ঘাসের পরিমাণের ক্ষেত্রে কোন বাধা ধরা নিয়ম নেই। তবে সর্বদা ‘ফিডিং রিং ঘাস দ্বারা পূর্ণ রাখতে পারলে ভালো। সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য মাসে একবার জাল টেনে নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের গড় ওজন বের করে মোট সংখ্যা দ্বারা গুণ করে জীবভর নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করা যেতে পারে।
মাছের পরিচর্যা :
পুকুরে মাটি ও পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে সার ও খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত । মাছের শারীরিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও রোগবালাই পরীক্ষা করার জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার জাল টেনে নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত । পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও প্ল্যাংকটনের পরিমাণ নিয়মিতভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন। মাছ ধরে পুনরায় পুকুরে ছাড়ার পূর্বে শোধন করে তথা জীবাণুমুক্ত করে পরে পুকুরে ছাড়তে হবে।
এ কাজে ২০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট অথবা ২০ লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে উক্ত দ্রবণে ধৃত মাছগুলোকে ১ মিনিট গোসল করিয়ে পরে পুকুরে ছাড়তে হবে। এর পরেও কোনো রোগ বালাই দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাছের রোগবালাই :
রাজপুঁটি মাছ মূলত খুব শক্ত গড়নের মাছ এবং এরা প্রতিকূল পরিবেশেও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তাই এদের রোগ-বালাই অন্যান্য মাছের তুলনায় কম। তবে অত্যধিক প্রতিকূল পরিবেশ তথা বিরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কিছু কিছু রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে, যেমন- ক্ষত রোগ, আঁইশ উঠে যাওয়া রোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ ইত্যাদি।
সাধারণত শীতের শুরুতেই এসব রোগবালাই হয়ে থাকে । আর একবার রোগবালাই শুরু হলে রোগের চিকিৎসা করে তত ভালো ফল পাওয়া যায় না । তাই রোগ যেন না হয় তার জন্য পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন এবং ১ কেজি লবণ ব্যবহার করলে ক্ষত রোগসহ অন্যান্য রোগের প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যায় ।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ :
সময়মতো মাছ আহরণ ও বিক্রি সফল মাছচাষের জন্য অপরিহার্য। একই সময়ে মজুদ করা হলেও সব মাছ একই সাথে সমভাবে বাড়ে না। কিছু মাছ দ্রুত বাড়ে আবার বাকিগুলো ছোট থেকে যায়। সেই জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছ বাজারজাত উপযোগী হলে অবশ্যই বাজারে বিক্রি করে দেয়া উচিত। এভাবে আংশিক আহরণ পদ্ধতিতে কিছু মাছ ধরার পর আহরণকৃত মাছের সংখ্যা পূরণ করার জন্য বড় আকারের সমপরিমাণ পোনা পুকুরে ছাড়তে হবে।
পোনা মজুদের ৩ মাসের মধ্যেই সরপুঁটি মাছ বিক্রি উপযোগী হয় অর্থাৎ ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায়। এভাবে আংশিক আহরণ এবং পুনঃমজুদ পদ্ধতিতে অল্প জায়গা হতে অনেক বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। থাই সরপুঁটি মাছ আহরণ করা বেশ সহজ। বেড় জাল, ঝাঁকি জাল, ফাঁস জাল ইত্যাদি দ্বারা অতি সহজেই এ মাছ আহরণ করা যায়।
আহরণের সাথে সাথে জীবিত অথবা তাজা অবস্থায় বাজারজাত করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করলে উজ্জ্বল রূপালী চকচকে মাছ অতি সহজেই ক্রেতা সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম । বর্ণিত পদ্ধতিতে চাষ করলে একক চাষের ক্ষেত্রে ৩-৪ মাসে শতাংশ প্রতি কমপক্ষে ৮-১০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। বাৎসরিক পুকুরে এ মাছের চাষ করা হলে বছরে ২টি ফসল তোলা সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে ।
আরও দেখুনঃ