ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন নিয়ে আজকের আলোচনা। মিঠা পানির জলাশয়ে যে মাছগুলো পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ট্যাংরা অন্যতম। মাছটি খুবই সুস্বাদু, মানব দেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাটা কম বিধায় সবার নিকট প্রিয়। এক সময় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত কিন্তু শস্য ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে।
ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন
এমতাবস্থায় প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ট্যাংরার কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষের কলাকৌশল উদ্ভাবন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাতিটির সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে মাছটির কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও পোনা প্রতিপালন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফলতা লাভ করেছেন।
খরাপ্রবণ রংপুর অঞ্চলে বেশির ভাগ জলাশয়ে ৫-৬ মাস পানি থাকে এবং এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ট্যাংরা পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে মৌসুমি জলাশয়ে চাষের আওতায় অন্যান্য মাছের বিকল্প হিসেবে মজুদ করতে পারলে এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে।
ট্যাংরা মাছের বৈশিষ্ট্য:
অর্থনৈতিক, সুস্বাদু ও পুষ্টিমান বিবেচনায় ট্যাংরা মাছের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
নিম্নে এই মাছের বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো :
* হ্যাচারি ও পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মিানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বিদ্যমান থাকে।
* ছোট এবং মৌসুমি জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
* খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় মাছের তুলনায় এই মাছগুলো বেশি পছন্দ করে।
* বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি।
ট্যাংরা মাছের ব্রুড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন :ট্যাংরা মাছের ব্রুড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশলের জন্য নিম্নের পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতে হয়।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি :
ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৮-১০ শতাংশ ও গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়।
ব্রুড মাছ ছাড়ার আগে পুকুর শুকিয়ে প্রথমে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগের ৫ দিন পর শতাংশে ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫ গ্রাম ও গোবর ৪ কেজি ব্যবহার করা হয়।ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের চারপাশে জালের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা দিতে হবে।
ট্যাংরা মাছের ব্রুড মজুদ
বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ট্যাংরা মাছের প্রজননকাল হিসেবে স্বীকৃত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বেই অর্থাৎ জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত ৮-১০ গ্রাম ওজনের ট্যাংরা মাছ সংগ্রহ করার পর প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০টি ট্যাংরা মজুদ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রুড তৈরি করা হয়।
খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা
ব্রুড মাছের পরিপক্বতার জন্য প্রতিদিন দুই বার করে খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া ২৫% ফিসমিল ৩০%, সরিষার খৈল ২০%,মিট এন্ড বোনমিল ২৫% হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। মাছের দৈহিক ওজনের ৮-৫% হারে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মজুদের ২ মাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পরপর জাল টেনে ব্রুড মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
কৃত্রিম প্রজনন কৌশল
প্রজনন মৌসুমের পূর্বে পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী ব্রুডের প্রতিপালন পুকুর থেকে সিস্টার্নে স্থানান্তর করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ২ঃ১ অনুপাতে মসৃণ জর্জেট হাপায় স্থানান্তর করা হয়। সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করা হয়। ট্যাংরার স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড (পিজি) অথবা ওভাটাইডের দ্রবণ বক্ষ পাখনার নিচে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।
সারণি ১ : ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজননে একক মাত্রার পিজি অথবা ওভাটাইড হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগহরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৮-৯ ঘণ্টা পর স্ত্রী ট্যাংরা ডিম ছাড়ে। ডিম আঠালো অবস্থায় হাপার চারপাশে লেগে যায়। ডিম দেয়ার পর হাপা থেকে ব্রুডগুলো সরিয়ে নিতে হয়।
ডিম ছাড়ার ২০ থেকে ২২ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়।
রেণুর ডিম্বথলি নিঃশোষিত হওয়ার পর রেণুকে খাবার দিতে হবে। রেণু পোনাকে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৬ ঘণ্টা পর পর ৪ বার দেয়া হয়। হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে সপ্তাহব্যাপী রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেয়া হয়।ট্যাংরা মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা
নার্সারি পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতিপোনা প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৪-৮ শতাংশ, গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়। পুকুর প্রস্তুতির জন্য পুকুর শুকিয়ে প্রতি শতকে ১ কেজি চুন দেয়া হয়। এরপর শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম টিএসপি ও ৬-৮ কেজি গোবর সার ব্যবহার করা হয়। পুকুরের চারপাশে নাইলন নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।পোনা সংগ্রহ ও নার্সারি পুকুরে মজুদহ্যাচারিতে উৎপাদিত ৭ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ৮,০০০-১২,০০০টি হারে মজুদ করা যায়।
নার্সারি পুকুরে মজুদের সময় পোনাকে পুকুরের পানির তাপমাত্রার সঙ্গে ভালোভাবে খাপখাওয়ানোর পর ছাড়তে হবে।
নার্সারি পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ
হ্যাচারীতে উৎপাদিত ৭ দিন বয়সের রেণু পোনা নার্সারি পুকুরে মজুদের পর প্রতি ১০,০০০টি পোনার জন্য খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
সরণি ২ : ট্যাংরা মাছের নার্সারি পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা
রেণু পোনা ছাড়ার ৫৫-৬০ দিন পর আঙুলে পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী এবং বাঁচার হার শতকরা ৫৫-৬০%।
ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা
পোনা মজুদের ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামেনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।
পোনা উৎপাদন ও আহরণ
নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদের ৫৫-৬০ দিন পর পুকুর সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ৫-৬ সেমি. আকারের ট্যাংরা মাছের পোনা পাওয়া যায়।
ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণালব্ধ কৌশল অনুসরণ করলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিসমূহে ট্যাংরা মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ করা গেলে চাষের মাধ্যমে এতদাঞ্চল তথা দেশে প্রজাতিটির উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এ প্রজাতির উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন: