আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় জীব বৈচিত্র্য, মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন।
জীব বৈচিত্র্য, মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন
জীববৈচিত্র্য শব্দটি ইংরেজি Biodiversity শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। জীববৈচিত্র্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট স্থানের জীবের প্রকরণ ও বিভিন্নতা। এই বিভিন্নতা প্রজাতি ও পপুলেশনের বংশগতির বিভিন্নতা হতে পারে। তাছাড়া পরিবেশের পরিবর্তন তাদের আন্তঃক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট প্রকরণও হতে পারে ।
আমাদের চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, ইত্যাদি এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি রয়েছে। এছাড়া আছে অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির অণুজীব, যেগুলোকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না । জীববৈচিত্র্য শুধু জীবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এদের আবাসভূমির প্রকরণ এবং বিস্তৃতিও এর অর্ন্তভুক্ত।
জলজ জীববৈচিত্র্য :
জলজ জীববৈচিত্র্য বলতে জলজ পরিবেশে উপস্থিত সব প্রাণী ও উদ্ভিদ বা জীবকুলের সমৃদ্ধতা বুঝায় । যেমন- কোনো জলাশয়ের সকল জলজ প্রাণী, তথা মাছসমূহ, জলজ উদ্ভিদসমূহ, অণুজীবসমূহ মিলেই সেখানকার জীববৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে। আর সেখানে প্রত্যেকের অবস্থান বা উপস্থিতি অপরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে ভারসাম্য রক্ষা করে।
আগে সাধারণত মনে করা হতো যেসব জীব বা প্রাণী মানুষের সরাসরি উপকারে লাগে কেবল সেগুলোই পরিবেশে রাখতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে মানুষ তাঁর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে অনুভব করেছে যে, পরিবেশে উপস্থিত সব জীবেরই একটি গুরুত্ব রয়েছে এবং একটি বিশেষ বস্তু বা প্রজাতির সর্বনিম্ন পরিমাণের উপস্থিতি সেখানে নিয়ন্ত্রক বা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে । যেমন- গুইসাপ সরাসরি মানুষের উপকার করে না, কিন্তু দেখা যায় গুইসাপের উপস্থিতি অন্যান্য বিষধর সাপের উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই গুই সাপের অনুপস্থিতিতে বিষধর সাপের প্রাধান্য বাড়তে বাড়তে মানুষের উপস্থিতিকে বিপন্ন করতে পারে ।
আবার দেখা যায় কিছু বিশেষ বৃক্ষ মশার বৃদ্ধি ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে। আবার কিছু জলজ আগাছা মশার জন্ম ও বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। আবার অনেক সময় নদীর গভীরতম অংশ যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ছোট মাছ বিদ্যমান থাকে সেখানে শুশুকের উপস্থিতি দেখা যায়। অর্থাৎ শুশুকের উপস্থিতি ছোট মাছের প্রাচুর্য্যতা নিশ্চিত করে। এমনিভাবে আমাদের জলাভূমিতে উপস্থিত প্রতিটি প্রজাতিই কোনো না কোনো স্বাভাবিক গুরুত্ব নিয়ে প্রকৃতিতে অবস্থান করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে জীববৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

মৎস্য জীববৈচিত্র্য হ্রাসের মানবসৃষ্ট কারণসমূহ :
মৎস্য জীববৈচিত্র্য হ্রাসের মানব সৃষ্ট কারণসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো ।
- অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, অন্যান্য বাঁধ ও সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণের ফলে মাছের তথা
- জলজ জীবের আবাসস্থল ধক্ষংস হচ্ছে; জলাভূমি ভরাট করে কৃষি কাজ করা;
- বিচার বিবেচনা না করে কৃষি জমিতে যথেচ্ছভাবে কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে পানি দূষণ;
- বিভিন্ন মৎস্য প্রজাতির অতি আহরণ;
- মৎস্য প্রজাতিসমূহের আশ্রয়স্থল ও প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ধ্বংস করা;
- সেচের মাধ্যমে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা;
- বিভিন্ন নতুন প্রজাতির আগমনের ফলে স্থানীয় ও দেশীয় প্রজাতি সমূহ বিলুপ্ত হচ্ছে। যেমন- উচ্চ ফলনশীল বিদেশি মাছ চাষ করার ফলে কোথাও কোথাও দেশি প্রজাতি বিলুপ্তি হচ্ছে;
- ক্রমাগতভাবে কৃত্রিম প্রজননের ফলে মূল প্রজাতির পরিবর্তন ও স্বাভাবিক জিনগত অবনতি ঘটছে;
- প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ধরে ফেলা হচ্ছে ফলে পরবর্তী মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ পাওয়া যাচ্ছে না;
- মাছের প্রাকৃতিক লালন ও বিচরণ ক্ষেত্রগুলো হতে নির্বিচারে মাছ আহরণ;
- মৎস্য সম্পদের নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অনুপস্থিতি ।
মৎস্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায়সমূহ :
মৎস্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায়সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো ।
- বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সাথে ফিশপাশ বা মৎস্যবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করা যাতে করে প্রজননক্ষম মাছ প্রজননের জন্য বিল বা হাওর থেকে নদীতে এবং নদী থেকে বিলে অবাধে বিচরণ করতে পারে। খুব বেশি
- প্রয়োজন না হলে জলাভূমি ভরাট করে কৃষি কাজ না করা । এছাড়াও প্রতি একক কৃষি ভূমির চেয়ে প্রতি একক জলাভূমির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। এ তথ্য কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় প্রচার করা ।
- কৃষি জমিতে বিচার বিবেচনা সাপেক্ষে কীটনাশক ব্যবহার করা বা জৈবিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয় এমন ওষুধ ব্যবহার করা। তবে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (IPM) মাধ্যমে রোগ বালাই প্রতিরোধ ও দমনের ব্যবস্থা নেয়া সবচেয়ে উত্তম।
- মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয় এমন স্থান থেকে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করা,
- অতি আহরণ রোধকল্পে মৎস্য সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে মেনে চলা বা অতি আহরণের ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় জনগণকে অবহিত করা। মৎস্য সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে সময় উপযোগী করা এবং আইন প্রয়োগের সব ক্ষমতা ও
- লজিষ্টিক সাপোর্ট মৎস্য বিভাগীয় কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত করা ।
- দূষণ প্রতিরোধকল্পে পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা । অর্থ্যাৎ কোন শিল্প স্থাপনের পূর্বেই বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা ।
- প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ আহরণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা ।
- প্রজনন ক্ষেত্রসমূহে অভয়াশ্রম স্থাপন এবং তা সংরক্ষণ করা । প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৎস্যজীবীদের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন করে তোলা ।
- তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কালে যেন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করা।
- পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনসহ জাটকা নিধন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা।
- সব অবৈধ জাল দ্বারা মাছ ধরা বন্ধ করা ।
আরও দেখুনঃ