জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা – যা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ এর অন্তর্ভুক্ত।

জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা

 

জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা

 

জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । আমাদের খাদ্য তালিকায় ভাতের পরেই মাছের স্থান। সারা বিশ্বে মাছ মানুষের প্রধান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটায়। আমিষ ছাড়াও মাছে অন্যান্য খাদ্য উপাদানও রয়েছে। শিশুদের এবং সন্তানসম্ভবা মহিলাদের জন্য মাছ একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য। মাছের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-

ক. আমিষের উৎস হিসেবে মাছ

আমাদের দেশে প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস মাছ বা মৎস্য সম্পদ। প্রয়োজনীয় আমিষের শতকরা ৬০ ভাগ এ সম্পদ থেকে পেয়ে থাকি। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকা, দেহের ক্ষয় পূরণ এবং বৃদ্ধি সাধনের জন্য প্রতিদিন নুন্যতম ৫৬ গ্রাম আমিষ জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজন ।

কিন্তু আমরা আমাদের খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ ও প্রাণিজাত উৎস মিলে গড়ে মাত্র ৫২ গ্রাম আমিষ পেয়ে থাকি (বিবিএস, ২০১৪-১৫)। এছাড়াও মাছের দেহে রয়েছে মানব দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ১০টি অ্যামাইনো এসিড। উদ্ভিজ্জ আমিষে শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় সব অ্যামাইনো এসিড বিদ্যমান থাকে না বা থাকলেও কিছু কিছু উপাদান খুবই কম পরিমাণে বিদ্যমান থাকে । মাছের প্রাণিজ আমিষ উদ্ভিজ্জ আমিষের চেয়ে সহজে হজমযোগ্য। মাছের আমিষ ৮৫-৯৫ শতাংশ হজমযোগ্য। ফলে দিন দিন সচেতন মানুষ গরু, খাসি বা মুরগির মাংসের চেয়ে খাদ্য তালিকায় মাছকে প্রাধান্য দিচ্ছে ।

খ. লিপিডের উৎস হিসেবে মাছ

লিপিডের উৎস হিসেবে মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মাছ ছাড়াও গরু বা খাসির মাংস থেকে আমরা লিপিড বা চর্বি পেয়ে থাকি। গরু বা খাসির মাংস উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত হওয়ায় হৃদরোগ বা স্ট্রোক-এর ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে শরীরে কোলেস্টেরল তো জমেই না, বরং শরীরে জমাকৃত খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । বিশেষ করে ইলিশ, টুনা, ম্যাকরেল প্রভৃতি মাছের তেল রক্তের কোলেস্টেরল হ্রাসে সহায়তা করে থাকে ।

এছাড়াও মাছের দেহে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড নামক এক ধরনের অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড । এ ফ্যাটি এসিড রক্তের অনুচক্রিকাকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, ফলে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায় । ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদরোগ, স্ট্রোক, মানসিক হতাশা, আথ্রাইটিস রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস করার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা হ্রাস করে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

গ. ভিটামিনের উৎস হিসেবে মাছ

মলা, ঢেলা, দারকিনা, কাচকি, পুঁটি প্রভৃতি ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দৈনিক ১০০ জন শিশু কেবল ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত কারণে অন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য তালিকায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ মাছ গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি করে আমরা এ সমস্যা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পেতে পারি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৪ থেকে ৬ বছর বয়সের একটি শিশুকে যদি দৈনিক মাত্র ২৩ গ্রাম মলা মাছ খাওয়ানো হয় তাহলে তার শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর প্রয়োজন মিটে যায় এবং সে অপুষ্টিজনিত অন্ধত্ব থেকে রেহাই পায় ।

মাছের যকৃৎ ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘ডি’-তে সমৃদ্ধ; যা হাড়, দাঁত, চর্ম ও চোখের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় মাছে প্রচুর ভিটামিন ‘বি’, বিশেষ করে ভিটামিন ‘বি৬’ ও নিয়াসিন রয়েছে। এগুলো চর্ম ও স্নায়ুবিক রোগের জন্য বিশেষ উপকারী। সুতরাং পরিবারে ভিটামিনের অভাব পূরণে মাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

ঘ. খনিজ লবণের উৎস হিসেবে মাছ

মাছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ যেমন- লৌহ, তামা, দস্তা, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ মা ও শিশু রক্তশূন্যতাজনিত রোগে ভোগে। এর অন্যতম কারণ খাবারে প্রয়োজনীয় লৌহের অভাব । জিওল মাছ হিসেবে পরিচিত শিং, মাগুর, কৈ প্রভৃতি মাছ সন্তানসম্ভবা বা প্রসোবোত্তর মায়ের রক্ত স্বল্পতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব মাছ দেহে দ্রুত রক্তকণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে।

তাই পুষ্টির জন্য সন্তানসম্ভবা মা এবং বাচ্চাকে দুধদানকারী মায়েদের জন্য ছোট মাছ আদর্শ খাদ্য। আবহমান কাল থেকে শিং, মাগুরের ঝোল রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ছাড়া মাছ থেকে প্রাপ্ত লৌহ উদ্ভিজ্জ খাবার থেকে প্রাপ্ত লৌহ অপেক্ষা উন্নত। ক্যালসিয়ামের অভাবে বাচ্চাদের শরীরের হাড় সুগঠিত হয় না। মাছের কাঁটা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের একটি ভালো উৎস ছোট মাছ কাঁটাসহ খাওয়া যায় বিধায় এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস পাওয়া যায়। পরিবারের সদস্যদের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের চাহিদা পূরণে ছোট মাছ তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ।

 

জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা

 

এছাড়াও দেশের শতকরা ৭০ ভাগ লোক কোনো না কোনো ধরনের আয়োডিনের অভাবজনিত রোগে ভোগে। খাবারে আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড রোগ হয়। উত্তরবঙ্গে এ হার অনেক বেশি। কেবল তাই নয়, আয়োডিনের অভাবে মূক-বধিরসহ শারীরিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে পারে। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে বিধায় সামুদ্রিক মাছ আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ থেকে পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে পারে। এ ছাড়াও সামুদ্রিক মাছের ফ্লোরাইড দাঁতের ক্ষয়রোধ করতে বিশেষভাবে কার্যকর। তাই নিয়মিতভাবে ও পরিমিত পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ গ্রহণ করলে পুষ্টি সমস্যা দূর হতে পারে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment