চাষযোগ্য মাছ সম্পর্কে ধারণা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় চাষযোগ্য মাছ সম্পর্কে ধারণা।

চাষযোগ্য মাছ সম্পর্কে ধারণা

আমাদের দেশে স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। যার সবগুলোই বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা যায় না। আবার চাষ করলেও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যায় না। যেহেতু একটা জলাশয়ে নির্ধারিত কতিপয় প্রজাতির মাছচাষ করা যায় এবং সব প্রজাতির মাছচাষ করা যায় না, তাই যে প্রজাতির মাছ চাষ করা হবে তার ন-বৃত্তান্ত না জানলে সঠিকভাবে মাছের পরিচর্যা করা যায় না, যেমন- যে মাছের যে রকম খাদ্যাভ্যাস তাকে জীবন- সে ধরনের খাদ্য না দিয়ে অন্য খাদ্য দিলে ঐ খাদ্য ঐ মাছের কোনো কাজে লাগে না, পক্ষান্তরে মৎস্যচাষির ব্যয় বাড়ে।

আবার সকল মাছের শারীরিক গঠনও এক রকম নয়। যেমন- কোনো মাছের শরীর আঁইশ দ্বারা আবৃত (কার্প জাতীয়), আবার কোনো মাছের শরীরে কোনো আঁইশ নাও থাকতে পারে (ক্যাট ফিশ)। কোনো কোনো মাছ নরম হাড় বিশিষ্ট (হাঙ্গর)। আবার কোনো কোনো মাছ শক্ত হাড় বিশিষ্ট (রুই মাছ)। মিঠাপানিতে চাষযোগ্য সব মাছই শক্ত কাঁটাযুক্ত। তাই মৎস্যচাষি বা মৎস্য সেক্টরে জ্ঞান আহরণকারী ছাত্র-ছাত্রীর সুবিধার্থে নিচে কতিপয় প্রধান প্রধান চাষযোগ্য দেশী-বিদেশী মাছের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও তাদের কার্যাবলিসহ জীবন-বৃত্তান্ত সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো-

মাছের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ :

মাছের দেহকে প্রধানত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—

ক. মাথা- মুখ থেকে কানকো পর্যন্ত বিস্তৃত;

খ. ধড়- কানকোর পিছন থেকে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত;

গ. লেজ- পায়ুছিদ্র থেকে পিছনের অংশ।

মাথা :

মাছের মাথা শরীরের প্রধানতম অঙ্গ । দুই পাশে চাপা দেহ বিশিষ্ট (Laterally flattend) অধিকাংশ মাছের মাথা ত্রিকোণাকৃতির। মাছের মাথার সম্মুখভাগে মুখছিদ্র বা মুখ, মুখের ঠিক পিছনে নাসারন্ধ্র অবস্থিত । সাধারণত মাছের দুটি নাসারন্ধ্র থাকে। এ নাসারন্ধ্রের সাহায্যে মাছ ঘ্রাণ নেয়, তবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় না ।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

চোখ :

মাথার দুই পাশে দুটি গোলাকার চোখ বিদ্যমান থাকে। তবে মাছের চোখে কোনো পর্দা নেই ফলে মাছ কখনই চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে পারে না। তবে চোখের উপর স্বচ্ছ আবরণ দ্বারা আবৃত থাকায় পানির কোন ভাসমান কণা চোখের ক্ষতি করতে পারে না ।

কানকো :

মাছের মাথার দু’পাশে ফুলকার উপর অর্ধচন্দ্রাকৃতির পাতলা শক্ত দুটি ঢাকনা থাকে। এ অর্ধচন্দ্রাকৃতির ঢাকনাকে অপারকুলাম বা কানকো বলে। কানকোর নিচে নরম পর্দা লাগানো থাকে যা ফুলকা প্রকোষ্ঠকে ভালোভাবে বন্ধ করতে সাহায্যে করে। জীব বিজ্ঞানের পরিভাষায় এ পর্দাকে Branchiostegal membrane বলে । কানকোর সাহায্যে মাছ ইচ্ছেমতো ফুলকা প্রকোষ্ঠ খুলতে ও বন্ধ করতে পারে। এছাড়াও মুখ দ্বারা গৃহীত অতিরিক্ত পানি এ পথে বের করে দিতে পারে ।

ফুলকা :

আকৃতিগত দিক থেকে ফুলকা দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি এবং অধিক ঘন দাঁত বিশিষ্ট চিরুনির মতো । এটা মাছের মাথার দুই পাশে কানকোর নিচে অবস্থান করে । এ অংশকে ফুলকা প্রকোষ্ঠ বলে । সাধারণত অধিকাংশ মাছের প্রতি পাশে চারটি করে মোট আটটি ফুলকা দণ্ড থাকে। মাছের প্রজাতি ভেদে ফুলকাদণ্ডের সংখ্যা বিভিন্ন হয়ে থাকে। ফুলকা দেখতে টকটকে লাল রঙের হয়। আর এ ফুলকা দেখে খুব সহজেই মাছ তাজা বা পচা তা বুঝা যায় । ফুলকা দ্বারা মাছ পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে ।

মাছ মুখ দিয়ে পানি নিয়ে ফুলকার ভিতর দিয়ে কানকো পথে বের করে দেয়। ফুলকার গঠন প্রকৃতি অনুসারে ফুলকা থেকে পানি বের হতে পারে কিন্তু খাদ্যকণা ফুলকায় আটকে যায়। এভাবে কোনো কোনো প্রজাতির মাছ পানিতে ভাসমান খাদ্যকণা ফুলকার সাহায্যে হেঁকে খেতে পারে। যেমন- সিলভার কার্প, কাতলা ইত্যাদি ।

শুঁড় কিছু কিছু মাছের মুখে ঠোঁটের উপরে ও নিচে কোমল সুতার ন্যায় জোড় সংখ্যক লৰা, নলাকৃতি যে অঙ্গ দেখা যায় তাকে শুঁড় বা বার্বেল বলে। শিং, মাগুর, ট্যাংরা, বোয়াল, প্রভৃতি মাছের মুখে শুঁড় রয়েছে। ইংরেজিতে আঁইশ বিহীন, শুঁড় ও তিন কাঁটা বিশিষ্ট মাছকে Cat Fish বলে। শুঁড় মাছের খাবার খুঁজতে ও কোন বস্তুর অবস্থান ও প্রকৃতি জানতে সহায়তা করে ।

আইশ :

অধিকাংশ মাছের দেহ আঁইশ দ্বারা আবৃত। আঁইশ মাছকে বিভিন্ন রকম রোগজীবাণু ও পরজীবীর হাত থেকে রক্ষা করে। আইশের উপরে এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ বিদ্যমান থাকে যাকে মিউকাস বলে। এ পিচ্ছিল আবরণ মাছের শরীরের রোগ বালাই ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় আঁইশ দেখে মাছের বয়স নির্ণয় করা হয়। মাছের আঁইশ দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা—

 

চাষযোগ্য মাছ সম্পর্কে ধারণা

 

ক. গোলাকার আঁইশ (Cycloid scale) :

রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছে এ ধরনের আইশ দেখা যায় ।

খ. চিরুনি আকৃতির অংশ (Ctenoid scale) :

কই মাছে এ ধরনের আঁইশ দেখা যায় ।

পাখনা :

মাছের চলাফেরা, গতিপথ পরিবর্তন, সাঁতার কাটা প্রভৃতি কার্যসম্পাদনের জন্য পাখনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো কোনো পাখনা জোড় যেমন- বক্ষ পাখনা, শ্রোণী পাখনা এবং পায়ু পাখনা। আবার কোনো কোনো পাখনা বিজোড় যেমন- পৃষ্ঠ পাখনা, পুচ্ছ পাখনা। মাছের পাখনা কাঁটাযুক্ত এবং পাতলা পর্দা যারা কাঁটাগুলো আবৃত থাকে। জীববিজ্ঞানের পরিভাষার এগুলোকে পাখনা রশ্মি বলে। বিভিন্ন পাখনার মাছের প্রজাতিভেদে কাঁটার সংখ্যারও তারতম্য ঘটে। আবার প্রজাতিভেদে মাছের পাখনার আকার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে বা বিশ্লেষণ করে মাছের প্রজাতি শনাক্ত করা যায় ।

 

চাষযোগ্য মাছ সম্পর্কে ধারণা

 

পাখনার অবস্থান অনুযায়ী এগুলোকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা যায়। যেমন-

ক. পৃষ্ঠ পাখনা,
খ. বক্ষ পাখনা,
গ. শ্রোণী পাখনা,
ঘ. পায়ু পাখনা, ও
ঙ. পুচ্ছ পাখনা।

পার্শ্বরেখা :

মাছের কানকো থেকে লেজ পর্যন্ত শরীরের দু’পাশে দুটি রেখা দেখা যায়। এ রেখাকে পার্শ্বরেখা (Lateral line) বলে। কোনো কোনো মাছে রেখাটি আগাগোড়া স্পষ্ট দেখা যায়। আবার কোনো কোনো মাছের রেখার সম্পূর্ণ অংশ বুঝা যায়না। পার্শ্বরেখা মাছের জন্য অনুভূতি নিরূপণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে । এ রেখা দ্বারা মাছ পানির নড়াচড়া, স্রোত, পানির চাপ ইত্যাদি বুঝতে পারে। এছাড়া রেখার উপরের আঁইশ গুণে মাছের প্রজাতি শনাক্ত করা যায়।

রেচন জনন ছিদ্র বা পায়ু :

মাছের দেহ শেষ হয়ে লেজ শুরু হওয়ার সীমানায় একটি ছিদ্র বিদ্যমান। এ ছিদ্রের মাধ্যমে মাছ বিপাকীয় অবশিষ্টাংশ দেহের বাইরে নির্গত করে এবং প্রজনন কার্য পরিচালনা করে থাকে । এ কারণে এ ছিদ্র রেচন জনন ছিদ্র নামে পরিচিত।

আরও দেখুন:

Leave a Comment