আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় চাষযোগ্য মাছের খাদ্য ও পুষ্টি।
চাষযোগ্য মাছের খাদ্য ও পুষ্টি
মাহকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা তথা জলজ পরিবেশে নিজেকে ভারসাম্যে রেখে টিকে থাকা, শরীর গঠন ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য জলজ পরিবেশ থেকেই খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। জীবনধারণ তথা বৃদ্ধি সাধনের নিমিত্ত্ব মাছ তার বসবাসরত পরিবেশ থেকে দুই ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। যথা- প্রাকৃতিক খাদ্য ও কৃত্রিম বা সম্পূরক খাদ্য। এ দুই ধরনের খাদ্যই গ্রহণ করার পরে মাছের দেহে কীভাবে প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদিত হয় তথা মাছের দেহের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করে দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তা একটি প্রবাহ চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল। তবে এর আগে খাদ্য বলতে কী বুঝি তা জেনে নেই ।
খাদ্য :
ক্ষুধা নিবারনের জন্য আহার্য্য হিসেবে মুখ দ্বারা গৃহিত যে সকল বস্ত্র শরীরের গঠন, বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ, তাপ উৎপাদন এবং পরিশেষে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা গড়ে তুলে তাকে খাদ্য বলে ।
মাছ বিভিন্ন উৎস হতে যেসব খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে থাকে পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে এগুলোকে ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- শর্করা, আমিষ, চর্বি, খনিজ লবণ বা মিনারেলস, ভিটামিন এবং পানি। এগুলোর মধ্যে আমিষ জাতীয় খাদ্য উপাদান স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যে এসব পুষ্টি উপাদানের কোনটি না থাকলে অথবা প্রয়োজনীয় অনুপাতে না থাকলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাতে থাকলে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় । সেজন্য মাছের খাদ্য তৈরি করতে উপরোক্ত পুষ্টি উপাদানসমূহ অবশ্যই প্রয়োজনীয় পরিমাণে থাকতে হবে। মাছের দেহে এগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট এনজাইম দ্বারা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে পরিপাক, পরিশোষন এবং আত্তীকরণের মাধ্যমে দৈহিক কাঠামোর মৌলিক যৌগসমূহ তৈরি হয়।
এগুলো থেকে প্রয়োজনীয় যে শক্তি উৎপন্ন হয় সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ শক্তিই মাছের খাদ্য পরিপাককরণে, জীবন ধারণের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসে, বিচরণ ক্ষেত্রে নিজেকে ভারসাম্যে রেখে চলাফেরায়, বংশগতি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রজননে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কার্যসম্পাদনে ব্যয় হয়ে থাকে। এসব জৈবিক ক্রিয়াদির পরিসমাপ্তির পরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট থাকে শুধুমাত্র সেটুকু শক্তিই মাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে থাকে। কাজেই এখানে সুস্পষ্ট যে, খাদ্য মাছের প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে বৃদ্ধি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে থাকে ।
১. প্রাকৃতিক খাদ্য :
কোনো জলাশয়ের পানিতে স্বাভাবিকভাবে যেসব খাদ্য উৎপন্ন হয় সেগুলোকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বলা হয় । উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন (অতি ক্ষুদ্র ভাসমান সবুজ উদ্ভিদকনা), প্রাণি প্ল্যাংকটন (অতি ক্ষুদ্র ভাসমান প্রাণী কনা), বেনথস (পুকুরের তলদেশে কাদার উপরিভাগে বা কাদার মধ্যে বসবাসকারী জীব),
পেরিফাইটন (জলজ উদ্ভিদের শাখা প্রশাখা বা পানিতে নিমজ্জিত শুকনা ডালপালার গায়ে জন্মানো বা আশ্ৰয় গ্রহণকারী প্রাণী) এবং ডেট্রাইটাস (পচনশীল জৈব বস্তু বিশেষত জলাশয়ের তলদেশে কাদার উপর পুঞ্জিভূত জৈব তলানী যা ব্যাকটেরিয়া কলোনী সমৃদ্ধ) হলো মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য হচ্ছে প্ল্যাংকটন।
প্ল্যাংকটন :
প্ল্যাংকটন হচ্ছে এক ধরনের আণুবীক্ষণিক প্রাণী বা উদ্ভিদ জাতীয় অণুজীব। প্রাকৃতিক পানির এসব অণুজীব পানিতে ভাসমান বা ঝুলন্ত অবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যমান থাকে এবং পানির প্রাথমিক উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্ল্যাংকটন মূলত দু’ধরনের, উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন এবং প্রাণি প্ল্যাংকটন।
কার্যগত দিক থেকে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন অটোট্রপিক (Auto trophic) এবং ক্রোমোপ্লাষ্ট (Chromoplast) ও অন্যান্য রঞ্জক (Pigment) সমৃদ্ধ। ফলে এরা সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানির সহায়তায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবের গ্রহণ উপযোগী শক্তিতে (কার্বোহাইড্রেট) রূপান্তরিত করতে পারে। এ কারণেই এরা প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে বিবেচিত।
অপরদিকে প্রাণী প্ল্যাংকটন হেটারোট্রপিক । এরা মূলত নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে না । খাদ্যের জন্য এরা পচনশীল জৈব বস্তু ও উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের ওপর নির্ভরশীল। মাছচাষের ক্ষেত্রে এ উভয় ধরনের প্ল্যাংকটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । এ সমস্ত প্ল্যাংকটন ও জীবের বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি সাধনের জন্য পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ করতে হয়।
পুষ্টিকর এ সমস্ত উপাদানের মধ্যে কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, লৌহ ও ম্যাগনেসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। এসব উপাদান বাজারে সরাসরি পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিকভাবে তা বিভিন্ন যৌগের আকারে সার হিসেবে পাওয়া যায়। তাই পুকুরের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অনুসারে মাঝে মাঝে পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হয় ।
উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন:
পুকুরের পানিতে যেসব অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থাৎ আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ নিমজ্জিত/ভাসমান অবস্থায় বিদ্যমান থাকে তাদেরকে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন বলা হয়। এদের নিজস্ব কোনো চলন ক্ষমতা নেই। এরা বাতাসের ধাক্কায় অথবা অন্য কোনো বাহক দ্বারা একস্থান হতে অন্য স্থানে চলাচল করে থাকে। অর্থাৎ এরা পানির ঢেউ বা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে না।
এদের দেহে ক্লোরোফিল নামক এক ধরনের রঞ্জক কণিকা বিদ্যমান থাকে। ক্লোরোফিলের বর্ণ সবুজ বিধায় পানিতে এদের আধিক্যের কারণে পানির বর্ণ হয় সবুজ যা মাছ চাষের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য এদেরকে মাছচাষের প্রথম ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়। যেমন- অ্যানাবেনা (Anabaena ), স্পাইরোগাইরা (Spirogyra ), নেভিকুলা (Navicula), ফেকাস (Phacus), ডায়াটম (Diatom), ব্লু-গ্রীন-অ্যালজি (Blue- Green-Algae) ইত্যাদি।
প্রাণি প্ল্যাংকটন:
পুকুরের পানিতে যেসব আণুবীক্ষণিক প্রাণী ও কীটপতঙ্গের লার্ভা নিমজ্জিত/ভাসমান অবস্থায় বিদ্যমান থাকে তাদেরকে প্রাণী প্ল্যাংকটন বলা হয়। এদের নিজস্ব চলন ক্ষমতা বিদ্যমান ফলে এরা পানির ঢেউ বা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে। প্রাণী প্ল্যাংকটন মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস । যেমন- ড্যাফনিয়া (Daphnia), সাইক্লপস্ (Cyclops), রোটিফেরা (Rotifera), মা (Moina ) ইত্যাদি ।
পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি নির্ণয়:
পোনা মজুদের পূর্বে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বিভিন্নভাবে আমরা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করতে পারি। যেমন- পুকুরের পানির বর্ণ দেখে, পানিতে সেকি ডিস্ক ডুবিয়ে, গামছা গ্লাস ইত্যাদি পদ্ধতিতে । পানির বর্ণ যদি হালকা সবুজ বা বাদামি বর্ণের হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ত উপস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে।
পানিতে সেকি ভিক্ষ ডুবিয়ে :
সেকিডিস্ক রিডিং যদি সর্বোচ্চ ১ ফুট হয় তাহলে সেখানেও মাছের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য বিদ্যমান রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
গ. গামছা প্লাস পদ্ধতি :
পুকুরে কিছুক্ষণ গামছা টেনে সেখান হতে একটি স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে এক গ্লাস পানি নিয়ে সূর্যের আলোতে পরীক্ষা করলে গ্লাসের মধ্যে ক্ষুদ্র প্রাণীকণা (গ্লাস প্রতি ১৫-২০টি) দেখা গেলে বুঝতে হবে পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় প্রাকৃতিক খাদ্য (প্রাণী প্ল্যাংকটন) বিদ্যমান রয়েছে।
আরও দেখুনঃ