গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা | অধ্যায়-৭ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা । যা ” গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।

শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

Table of Contents

গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা

 

গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা | অধ্যায়-৭ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। পেশিকলা গঠন ও জৈবিক ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ করে তাকে। আমিষ, চর্বি, শ্বেতসার, খাদ্যপ্রাণ ও খনিজ পদার্থ প্রভৃতি চিংড়ির খাদ্যের প্রধান পুষ্টি উপাদান। গলদা চিংড়ির খাদ্যকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) প্রাকৃতিক খাদ্য ও (২) সম্পূরক খাদ্য।

প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশে সাধারণত উন্নত সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। পুকুর প্রস্তুতকালে এবং পরবর্তীতে খামার ব্যবস্থাপনার সময় জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা হয়। এছাড়া আধা-নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় উন্নত সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতিতেও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস

চিংড়ি স্বভাবে নিশাচর প্রাণী। গলদা চিংড়ি সাধারণত রাতে খাদ্যের সন্ধানে পুকুর পাড়ের দিকে অল্প পানিতে বিচরণ করে এবং দিনের বেলায় গভীরে চলে যায়। এরা চিলেটযুক্ত পা দিয়ে বড় ধরনের দানাদার খাদ্য ধরে গলধকরণ করে থাকে। এরা সর্বভুক প্রাণী। খাদ্য হিসেবে গলদা চিংড়ি প্রধানত জলজ পোকা-মাকড় ও তাদের ডিম, শুক্রকীট বা সার্তা, অ্যালজি, শামুক, ক্রাস্টাশিয়ান, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী প্রভৃতি গ্রহণ করে থাকে।

প্রায় সকল ধরনের ক্রাস্টাশিয়ান জুপ্ল্যাংকটন ও শামুক গলদা চিংড়ির অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। এসব খাদ্যে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ থাকে যা চিংড়ির শারীরিক বৃদ্ধি ও খোলন তৈরির জন্য একান্ত প্রয়োজন। ক্ষুধার্ত চিংড়ি খাদ্যের অভাবে যা পায় তাই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। পুকুরে খাদ্যের স্বল্পতা দেখা গেলে সবল চিংড়ি দুর্বল চিংড়িকে আক্রমণ করে খেয়ে ফেলে।

প্রাকৃতিক খাদ্য

পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যের ওপর চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। পুকুরে চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্যের স্বল্পতা ঘটলে চিংড়ির প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যায় না। আমরা জানি, জীবমাত্রই জীবনধারণের প্রয়োজনে নানা জৈবিক কার্য সম্পন্ন করার জন্য শক্তির প্রয়োজন। আর শক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে সৌর শক্তি।

সৌরমণ্ড ল থেকে তাপ ও প্রয়োজনীয় গ্যাস (কার্বন) পানিতে দ্রবীভূত নানা পদার্থের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রাথমিকভাবে প্রথমে প্রাণের সৃষ্টি হয়। আর এই উদ্ভুত প্রাণীকেই বলা হয় উদ্ভিদকণা বা ফাইটোপ্লাংকটন। এই উদ্ভিদকণার জীবন চক্র সমাপ্তির পরই পানিতে প্রাণী কণার সৃষ্টি হয় এবং এরা খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ কনার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।

প্রাণীকণার বিনাশ প্রক্রিয়ায় দেহের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলো পানিতে মিশে যায়। এ ব্যাপারে পুকুরের মূল মৌলিক উপাদানগুলো একটি জটিল প্রক্রিয়ায় যৌগিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়ে পুনরায় সরল পদার্থরূপে পানিতে ফিরে আসে। আর এরূপেই প্রাকৃতিকভাবে পানির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়।

পুকুরে এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়া পুকুরের জলজ উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জীবাণু ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল। পুকুরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং উচ্চ শ্রেণিভুক্ত প্রাণীকূল পাশাপাশি অবস্থান করে। জীবনধারণ ও প্রয়োজনে এরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে জলজ পরিবেশে একটি খাদ্যশৃঙ্খলের (Food chain) সৃষ্টি হয়।

এই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রথম ধাপে অবস্থান করে উদ্ভিলবণা ও জলজ উদ্ভিদ এবং এরা প্রাথমিকভাবে খাদ্য উৎপাদন করে বলে এদেরকে খাদ্য উৎপাদক (Producer) বলা হয়। খাদ্য শৃঙ্খলের দ্বিতীয় ধাপে অবস্থানকারী প্রাণীকণা, নানা ধরনের চিংড়ি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণরূশে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। এদেরকে উৎপাদন জোশী (Consumer) বলা হয়।

প্রাকৃতিক খাদ্য দুই ধরনের, যথা-(১) উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন (Phytoplankton) ও (২) প্রাণী প্ল্যাংকটন (Zooplankton)

১) উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন:

গলদা চিংড়ি জীবনের বিভিন্ন দশায় নিম্নোক্ত উদ্ভিদ প্লাংকটন খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।

ক) হীলচে সবুজ শেওলা (Blue green algae): Spirulina sp. Oscilletoris sp, Anabaena sp. Nostoc sp.)

খ) সবুজ শেওলা (Green algse); Chlorella sp, Odogonilun sp, Cladophors sp; Desnis sp; Cosmarium ap; Orgonium sp.

গ) তারটামল (Diatoms): Navicula sp; Cyclotolla sp; Chastoceros sp; Gyrosigme sp; Secletenema sp.

ঘ) লুভজন্দর শেওলা (Filamentous algae): যদিও এসব উদ্ভিন কণা পুকুরে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয় তথাপি এসব প্রাকৃতিক উদ্ভিন প্ল্যাংকটন কৃত্রিম উপায়ে ঢাধ করে পুকুরে প্রয়োজনীয় মাত্রায় প্রয়োগ করা যায়। চিংড়ি প্রত্যক্ষ বা পরাক্ষেভাবে জলজ শেওলা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে খাকে। উদ্ভিদ প্যাংকটনের মধ্যে ডায়টম জাতীয় শেওলা চিংড়ির সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য।

২) প্রাণী প্লাংকটন (Zooplankton):

চিংড়ি নিম্নোক্ত প্রাণী প্ল্যাংকটনসমূহ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে:

ক) কণিগড (Copepod): Cyclops ap; Diaptomus sp

খ) ফ্লাভোসেয়া (Cladocers): Daphnis sp; Moina sp, Hosmina sp.

গ) অস্টাকড (Rotifers): Brachiomus ap; Renatella sp.

ঘ) অস্টাফত (Ostapod): Cypris ap.

ঙ) নোনা চিংড়ি জাতীয় ও আর্টিমিয়া ও আর্টমিয়ার লার্ভা দশ্য

সম্পূরক খাদ্যের গুরুত্ব

সম্পূরক খাদ্য

মাছ ও চিংড়ির দ্রুত বৃদ্ধি এবং অল্প সমরে অধিক উৎপাদন পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যয়ের পাশাপালি বাইয়ে থেকে যে সব বাড়তি খাবার দেয়া হয় এদেরকে সম্পূরক খাবার বলে। স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মাছ ও চিংড়ির খাদ্যেও নির্দিষ্ট মাত্রায় সকল পুষ্টি উপাদান যেমন- আমিষ, শর্করা, স্নেহ, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকা প্রয়াজন।

খাদ্যে এসব পুষ্টি উপাদানের কোনোটি প্রয়োজনীয় মাত্রায় না থাকলে মাছ ও চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে অধিক ঘনত্বে চাষ করলে শুধু জল প্রাকৃতিক খাদ্যে মাছ ও চিংড়ির সকল পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় না। মাছ ও চিংড়ির এ সকল চাহিদা পূরণের জন্য বাইরে হতে নিয়মিত বিভিন্ন ধয়দের খাবার পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়। যেমন- ফিসমিল, চিংড়ির মাখার গুড়া, কাঁকড়ার নাড়ি-কুড়ি ইত্যাদি।

সম্পূরক খাদ্যের গুরুত্ব

দৈহিক বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য মাছ ও চিংড়ি পুকুরের পরিবেশ থেকে প্রাণিকণা, উদ্ভিদকণা, তলদেশের পোকামাকড়, শুক্রকীট, ছোট ছোট কীটের লার্ভা, তলার কেঁচো, মৃত জৈব পদার্থ ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। কিনতু আধুনিক পদ্ধতিতে অধিক ঘনত্বে চাষ করলে এসব প্রাকৃতিক খাদ্য মাছ ও চিংড়ির প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদার যোগান দিতে পারে না। ফলে মাছ ও চিংড়ি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বৃদ্ধির হার কমে যায়। যা সার্বিক উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

মাছ ও চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা সৃষ্টির পাশাপাশি পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও কার্প-চিংড়ি মিশ্রচাষের পুকুরে চিংড়ির স্বজাতিক্রোজিতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্পূরক খাদ্যের ভূমিকা অপরিসীম।

পুকুরের পরিবেশে যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয় তখন এদের স্বজাতিভোজিতা বৃদ্ধি পায় এবং সবল চিংড়ি দূর্বলগুলোকে ধরে খায়। এর ফলে ব্যাপক হারে চিংড়ি মারা যেতে পারে। পরিমিত পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে চিংড়ির এ ক্ষতিকর স্বভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

বর্তমানে আমাদের দেশের পুকুর-দীঘি ও উপকূলীয় চিংড়ি ঘেরগুলোতে শতাংশ প্রতি মাছ ও চিংড়ির বার্ষিক গড় উৎপাদন যথাক্রমে ৬ কেজি ও ২-২.৫ কেজি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগে এ সমস্ত জলাশয়ে আধানিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করে খুব সহজেই ৫ গুণের বেশি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। নিচে মাছ ও চিংড়ি চাষে সম্পূরক খাবারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখ করা হলোঃ

  • ঋদিক ঘনত্বে মাছ ও চিংড়ি চাষ করা যায়।
  • অল্প সময়ে মাছ ও চিংড়ি বিক্রয় উপযোগী হয়।
  • মাছ ও চিংড়ির মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়।
  • মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • চিংড়ির স্বজাতিভোজিতা রোধ করে
  • অল্প আয়তনের জলাশয় হতে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়

খাদ্য নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়

আমাদের দেশে চাষিরা সম্পূরক খাবার হিসেবে প্রধানত খৈল ও কুঁড়া ব্যবহার করে থাকেন। এগুলো ছাড়াও প্রায় ‘সারাদেশেই চাষিদের এমন কিছু খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করতে দেখা যায় যাদের কিছু কিছু আর্থিকভাবে লাভজনক নয়, এমন কি কিছু কিছু পুকুরের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মাছ ও চিংড়ি অধিক উৎপাদন। সে কারণে পুকুরে প্রয়োগের জন্য খাদ্য নির্বাচনে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত। নিচে লাভজনকভাবে মাছ ও চিংড়ি চাষের জন্য খাদ্য নির্বাচনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় উল্লেখ করা হলোঃ

  • উপাদানসমূহের সহজলভ্যতা
  • চাষির আর্থিক সংগতি
  • উপকরণসমূহের মূল্য
  • মাছ ও চিংড়ির পুষ্টি চাহিদা
  • মাছ ও চিংড়ির পছন্দনীয়তা
  • উচ্চ খাদ্য পরিবর্তন হার

মাছ ও চিংড়ির পুষ্টি চাহিদা

সুস্থ সবলভাবে বেঁচে থাকা ও দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য মাছের খাদ্যেও সুষম খাবারের সবগুলো উপাদান অপরিহার্য। কিন্তু এসব খাদ্য উপাদানের মধ্যে আমিষ সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্রয়োজন। সে কারণে মাছ ও চিংড়ির পুষ্টি চাহিদা বলতে সাধারণভাবে আমিষের চাহিদাকে বুঝানো হয়।

মাছের খাদ্য তৈরিতে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলোর প্রত্যেকটিতে খাদ্যের অন্যান্য উপাদান যেমন শর্করা, চর্বি ও খনিজ লবণ বিদ্যমান থাকে। সে কারণে আমিষের চাহিদা পূরণ হলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলোর খুব একটা অভাব হয় না। মাছ ও চিংড়ির পুষ্টি চাহিদা এদের বয়স ও প্রজাতির উপর নির্ভর করে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, উৎপাদন পুকুরে রুই জাতীয় মাছ ও চিংড়ির খাদ্যে আমিষের চাহিদা যথাক্রমে ৩৫-৪০% এবং ৪০-৪৫%। অতএব, সর্বোচ্চ মাত্রার উৎপাদন পেতে হলে মাছ ও চিংড়ি দ্বারা গৃহীত খাদ্যে উল্লিখিত মাত্রার আমিন থাকা বাঞ্ছনীয়। কিনতু প্রাকৃতিক খাদ্য থেকে মাছ ও চিংড়ি মোট চাহিদার ৫-১৫% আমিষ পেয়ে থাকে। সেই বিবেচনায় তৈরি খাদ্যে ২৫-৩০% আমিষ থাকলেই খাদ্যকে সুষম হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

খাদ্যের পুষ্টিমান

আমাদের দেশে মাছ অথবা চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত কিছু প্রচলিত খাদ্য উপকরণের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে এদের মধ্যে উচ্চমানের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। গবেষণায় প্রাপ্ত কিছু খাদ্য উপকরণের পুষ্টিমান নিচের টেবিলে উল্লেখ করা হলো:

উপাদানের নামপুষ্টিমান (%)পুষ্টিমান (%)পুষ্টিমান (%)
আমিষশর্করাস্নেহ
চালের গুঁড়া১১.৬৮৪৪.৫২১০.৪৫
গমের ভূষি১৪.৫৭৬৬.৩৬৪.৪৩
সরিষার খৈল৩০.৩৩৩৪.৩৮১৩.৪৪
তিলের খৈল২৭.২০৩৪.৯৭১৩.১৮
ফিসমিল-এ গ্রেড৫৬.৬১৩.৭৪১১.২২
ফিসমিল-বি গ্রেড৪৪.৭৪১৬.৮২৭.৮৭
ব্লাডমিল৬৩.১৫১৫.৫৯০.৫৬
আটা১৭.১৮৭৫.৬০৩.৯০
চিটাগুড়৪.৪৫৮৩.৬২
ক্ষুদিপানা১৪.০২৬০.৮৮১.৯২
কুটিপানা১৯.২৭৫০.১৯৩.৪৯

মাছ বা চিংড়ির খাদ্যের পুষ্টিমান নির্ণয়ে শুধুমাত্র আমিষের মাত্রা হিসেব করা হয়। সাধারণ ঐকিক নিয়মে একাধিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি খাদ্যের পুষ্টিমান সহজেই নিরূপণ করা যায়। নিচে একটি উদাহরণের সাহায্যে খাদ্যে আমিদের মাত্রা নিরূপন পদ্ধতি দেখানো হলো।

ধরা যাক ফিসমিল, সরিষার খৈল, গমের ভূষি এবং বাইন্ডার হিসেবে আটা ব্যবহার করে ১ কেজি খাদ্য তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের অনুপাত হবে ফিসমিল ২৫%, সরিষার খৈল ২৫%, গমের ভুষি ৪০% ও আটা ১০%। তাহলে এ সমস্ত উপকরণগুলো ব্যবহার করে তৈরি খাদ্যে আমিষের মাত্রা উল্লিখিত খাদ্যে আমিষের মাত্রা হচ্ছে ৩০.০৮% ।

খাদ্য তৈরিতে উপকরণ ব্যবহারের অনুপাত:

মাছ ও চিংড়ির খাদ্য তৈরির জন্য কম মূল্যের উৎকৃষ্ট মানের খাদ্য উপকরণ এমনভাবে বেছে নিতে হবে যাতে এদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়, খাদ্যের মান বজায় থাকে এবং খাদ্য প্রয়োগ বাবদ পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়। আমাদের। দেশে প্রচলিত খাদ্য উপকরণ যেমন- খৈল, কুঁড়া, গমের ভুষি, ফিসমিল, আটা, চিটাগুড় ইত্যাদি ব্যবহার করেই মাছ ও চিংড়ির পুষ্টি চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন সম্পূরক খাদ্য তেরি করা যেতে পারে। 

মিশ্র খাদ্য ছাড়াও পুকুরে যদি গ্রাসকার্প ও সরপুঁটি থাকে তবে নিয়মিত ক্ষুদিপানা, কুটিপানা, নরম ঘাস, বিচি কলার পাতা, পেঁপে পাতা, আলুর পাতা, সজনে পাতা, নেপিয়ার ঘাস, শীতকালীন শাকসবজি ইত্যাদি দিতে হবে। গ্রাসকার্প প্রতিদিন এর দেহ ওজনের প্রায় ৪০-৪৫% পর্যন্ত সবুজ খাদ্য খেতে পারে।

খামারে তৈরি সম্পূরক খাদ্য

চিংড়ি চাষিরা সাধারণত চাউলের কুঁড়া, গমের ভুসি, ফিসমিন, গরু-ছাগলের নাড়িভূড়ি, সরিষার খৈল/তিলের খৈল ইত্যাদি খাদ্য উপাদান বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে চিংড়ির সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে থাকে। তবে চিংড়ি চাখিরা খামারে যে সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ চাষিরা খাদ্যের গুণগতমান দঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। 

উপরাক্তে নমুনাগুলোর যে কোনো একটি নমুনা অনুসারে সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে গলদা চিংড়ির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উপরাক্তে নমুনায় নির্দেশিত হারে পরিমাণমঞ্চ উৎকৃষ্ট খাদ্য উপাদানসমূহ আলাদা আলাদাভাবে মেপে নিতে হবে এবং অল্প অল্প করে একটি বড় পাত্রে শুকনা অবস্থায় উপাদানগুলো ভালোভাবে মিশাতে হবে।

খাদ্য উপাদানগুলো ভালোভাবে মেশানায়ে পর অল্প অল্প করে পানি দিয়ে সমস্ত মিশ্রণটি একটি আঠালো মত্ত বা পেইন্টে পরিণত করা হয়। তারপর এই মণ্ডকে হাত দিয়ে ছোট ছোট বল বানিয়ে জেলা খাদ্য হিসেবে সরাসরি খামারে প্রয়োগ করা যায়। আবার এই খাদ্য মেশিনে পিলেট বানিয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে দানাদার খাদ্যও তৈরি করা যায়।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

কারখানায় তৈরি খাদ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. চিংড়িয় দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন অ্যামাইনো অ্যাসিড, আমিষ, খাদ্যপ্রাণ,খনিজ পদার্থ ইত্যাদি যোগান দেয়।

২. কারখানায় তৈরি পিলেটের আকার ও গঠন এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে পিলেট পানিতে ডুবে থাকে এবং চিংড়ি সহজেই খেতে পারে।

৩. পানিতে এই খাদ্যের স্থায়িত্বঝাল অনেক বেশি। এই খাদ্য পানিতে সহজেই গলে যায় না এবং পানিতে প্রায় ৬ ঘন্টা পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় থাকে। ফলে পুকুরের তলদেশ দূষণমুক্ত ও পরিষ্কার থাকে।

৪. চিংড়ির খোলস বদলানো প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

৫. এই খাদ্যে সুগন্ধিযুক্ত উপাদান থাকে যা চিংড়িকে খাদ্য গ্রহণে আকৃষ্ট করে ও চিংড়ির ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সহয়তা করে।

৬. এই খাদ্যের স্থায়িত্ব কমপক্ষে ৪ মাস। ফলে এই খাদ্যকে একটি উৎপাদন মৌসুম পর্যন্ত সহজেই মজুদ রাখা যায়।

৭. পুকুত্রে এই খানোর অপচয় কম হয়।

৮. এই খাদ্য পানিতে সহজেই গলে যায় না বিষায় পানির গুণাগুণ নষ্ট করে না।

খাদ্য মজুদ রাখার পদ্ধতি

খাদ্য তৈরির পর খাদ্যের গুণগতমান সর্তকিক্ষণের জন্য সঠিকভাবে মজুদ করা দরকার। খাদ্যের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেলে সেই খাদ্য পুকুরে প্রয়োগ করা উচিত নয়। খাদ্যের গুণাগুণ যথাযথভাবে দরক্ষণের জন্য নিম্নবর্ণিত উপায়ে খাদ্যমজুদ করা দরকার।

১. শুদ্ধ, ঠান্ডা ও অবোধ বায়ু চলাচল করতে পারে এমন স্থানে রাখতে হবে।

২. পাকা বা কাঁচা মেকের ওপর কাঠ বিছিয়ে তার ওপর খাদ্য রাখতে হবে।

৩. সরাসরি সূর্যালোকে খাদ্য মজুদ করা ঠিক নয়। ছায়াযুক্ত স্থানে খাদ্য মজুদ করা ভালো।

৪. খাদ্য তৈরির পর অনধিক ৩ মাসের মধ্যেই খাদ্য ব্যবহার করা উচিত। পুরাতন খাদ্য খামারে ব্যবহার করা সঙ্গত নয়

সম্পূরক খাদ্য “পিলেটের আকার

চিংড়ি কোনো কোনো সময় সরাসরি পিলেট ভক্ষণ করে থাকে আবার কোনো কোনো সময় পিলেট নিয়ে সাঁতার কাটে। তাই পিলেট এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে পিলেট ভক্ষণ করা, বহন করা চিংড়ির জন্য কোনো সমস্যা না হয়। চিংড়ির আকার/এজনের ভিত্তিতে পিলেটের আকার নিচে দেয়া হলোঃ

চিংড়ির ওজন (গ্রাম)পিলেটের আকার
০-৩১ মিমি কণা বা ক্রাম্বল
৩-১৫২ মিলি-৪ মিমি কণা বা ক্রম্বেল
১৫-৪০২.৫ মিয়িস৫ মি মি

খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয়

চিংড়ির পুকুরে অতি সতর্কতার সাথে খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা বেশি হলে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বেশি হয় অন্যদিকে পানি দূষণেরও সম্ভাবনা থাকে। একটি পুকুরে কী পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ করা হবে তা নিম্নেক সূত্রের সাহায্যে নির্ধারণ করা যায়।

প্রতিদিন দেয় খাবারের পরিমাণ= (মোট মজুদকৃত চিংড়ি) × (বেঁচে থাকার হার (%) প্রতিটি চিংড়ির গড় ওজন ও খামারে প্রয়োগের মাত্রা (%))

উদাহরণস্বরূপ, একটি পুকুরে মোট মজুদকৃত চিংড়ির পরিমাণ = ১০০০০০টি

বেঁচে থাকার হার = ৭০%; প্রতিটি চিংড়ির গড় ওজন = ২০ গ্রাম

খাবার প্রয়োগের মাত্রা ৬% (মোট চিংড়ির ওজনের)

এক্ষেত্রে প্রতিদিন দেয় খাবারের পরিমাণ = ১০০০০০ × ৭০ গ্রাম × ২০ × ৬/১০০ =৮৪০০০ গ্রাম = ৮৪ কেজি

ফিডিং ট্রে পর্যবেক্ষণের পর চিংড়ির খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ কমাতে হবে এবং কী কারণে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমলো তা জেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবস্থার উন্নতি হলে খাবার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন কারণে চিংড়ির খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে যেতে পারে। কারণগুলো নিম্নরূপ:

– পুকুরে হঠাৎ ফাইটোপ্লাংকটন অধিক মাত্রায় মারা গেলে

– দীর্ঘদিন পুকুরের পানির পরিবর্তন করা না হলে

– পুকুরের পানির পিএইচ মাত্রা কমে গেলে

– পুকুরের তলদেশের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে

– চিংড়ি রোগাক্রান্ত হলে

– চিংড়ি খোলস পাল্টালে

– দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২.৫ শিপিএম এর নিচে নেমে গেলে

– পানির তাপমাত্রা ৩০° সে. এর উর্ধ্বে বা ২০” এর নিচে নেমে গেলে

চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ

ফিডিং ট্রে থেকে বা খেপলা জালের মাধ্যমে পুকুর থেকে চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করে পুকুরে চিংড়ির মজুদ নির্ণায় করা যায়। এছাড়া নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে চিংড়ির স্বাস্থ্য, বাঁচার হার ও পুকুরের তলদেশের অবস্থা জানা যায়। ৫ গ্রামের কম ওজনের চিংড়ির নমুনা ফিডিং ট্রে থেকে এবং এর অধিক ওজনের চিংড়ির নমুনা খেপলা জালের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ভালো।

খেপলা জালের মাধ্যমে মোট চিংড়ির সংখ্যা ও দৈহিক বৃদ্ধি জানার জন্য পুকুরের বিভিন্ন স্থানে ১০-১৫ বার জাল টেনে চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করে নিম্নেক্ত সূত্রের সাহায্যে চিংড়ির মজুদ নির্ণয় করা যায়।

মোট চিংড়ির সংখ্যা গড়ে একবারে ধৃত চিংড়ির সংখ্যা/জালের আয়তন (ব, মিটার) পুকুরের আয়তন (ব. মিটার)

জালের আয়রন ৩.১৪ × (জালের ব্যাসার্থ),

দৈহিক বৃদ্ধির হার নির্ণয়ের জন্য পুকুর থেকে ০-৪০ টি চিংড়ির দৈর্ঘ্য ও ওজন মেপে গড় ওজন বের করতে হবে। পুকুরে দৈনিক কি পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ প্রয়োজন তা নিমাক্তে সূত্রের সাহায্যে বের করা যায়। দৈনিক মোট খাদ্যের পরিমাণ = বেঁচে থাকা চিংড়ির সংখ্যা গড় ওজন খাদ্য সরবরাহের হার(%)।

বাস্তবে বাঁচার হার নির্ণয় করা একটি কঠিন কাজ। তবে পুকুরের সার্বিক অবস্থাদি ঠিক থাকলে পোনা মজুনের ১ ২ সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচার হার ৯০টি এবং সম্পূরক খাদ্য গ্রহণের সময় বাঁচার হার ৭০% প্রত্যাশা করা যায়। সাধারণত ৭-১০ দিন পর পর চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি ও বাঁচার হার নির্ণয় করা হয়।

অন্যদিকে প্রতিদিনই চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি হয়। ভাই একবার নমুনা সংগ্রহ করে দৈহিক বৃদ্ধি ও বাঁচার হার নির্ণয় করে টক ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী নমুনা সংগ্রহ পর্যন্ত খাদ্য। সরবরাহ না করে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে দৈনিক দৈহিক বৃদ্ধির পরিমাণ হিসেব ধরেই খাদ্য সরবরাহ করা উচিত এবং এতে চিংড়ির উৎপাদনেও ভালো ফল পাওয়া যায়।

গলদা চিংড়ির খাদ্য ব্যবহার হার

গড় ওজন (গ্রাম)দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ (%)
০.২-০.১১৫-১৩
১-২১৩-১১
২-৩১১-৯
৩-৪৯-৭
৫-১৩৭-৫
১৩-২০৫-৩
২০-৩০৩-২.৫

এফসিআর

খাদ্য সরবরাহের ফলে তা দৈহিক বৃদ্ধিতে কতটুকু সহায়তা হল তা জানার জন্য নিয়মিত প্রয়োজন এফসিআর (Food Conversion Ratic) নির্ধারণ চিংড়ি চাষের কোনো এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে এফসিআর হচ্ছে সে মূহুর্তে পর্যন্ত একটি পুকুরে সরবরাহকৃত সর্বমোট খাদ্য দ্বারা কী পরিমাণ চিংড়ি উৎপাদিত হলো।

কোনো একটি পুকুরে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত ২০০ কেজি খাদ্য সরবরাহ করে ১০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হলে সে মুহূর্তে এফসিআর হচ্ছে ১০০:২০০০ ১।২ অর্থাৎ ২ কেজি খাদ্য প্রয়োগ করে ১ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে।

পুকুরে পোনা মজুদের হার, খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ, খাদ্যের গুণাগুণ এবং আহরণকালে চিংড়ির আকারের ওপর সাধারণত এফসিআর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সাধারণত চিংড়ি চাষের শেষ পর্যায়ে এফসিআর ২ এর বেশি হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। চিংড়ি চাষের প্রথম দিকে সাধারণত চিংড়ি দ্রুত বাড়ে ফলে প্রথম দিকে এফসিআর চাঘের শেষের দিকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম হয়।

খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা

মাছ ও চিংড়ি চাষের পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের হার নির্ভর করে মূলত পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা, চাষ ব্যবস্থাপনা, খাদ্যের অবস্থা ও পুষ্টিমান ইত্যাদি বিষয়ের উপর। বড় মাছ ও চিংড়ির চেয়ে ছোট অবস্থায় এদের খাদ্য চাহিনা অনেক বেশি। সে কারণে উৎপাদন পুকুরে প্রথম দিকে বেশি মাত্রায় খাবার প্রয়োগ করতে হয়।

তবে মাছ ও চিংড়ি বড় হওয়ার সাথে সাথে খাদ্য প্রয়োগ হার কমে গেলেও মোট খাদ্যের পরিমান তুলনামূলক ভাবে বেড়ে যায়। নিচের সারশিতে উন্নত ব্যাপক পদ্ধতির চাষ ব্যবস্থাপনায় মাছ ও চিংড়ি চাষের পুকুরে দৈনিক খাদ্য প্রয়োগের নমুনা মাত্রা উল্লেখ করা হলোঃ

  • জুতেনাইল মজুদ করা হলে মাছ ও চিংড়িয় দেহ ওজনের ১০-৫% (খৈল, কুঁড়া, ফিসমিল জাতীয় খাবার)
  • পিএল মজুদ করা হলেও সপ্তাহ পর্যন্ত স্টার্টার ফিড
  • ৪ সপ্তাহ পর থেকে খৈল, কুঁড়া, ফিসমিল জাতীয় খাদ্য
  • খাবার মাছ ও চিংড়ির দেহ ওজনের ১০-৫%

সস্টার্টার ফিডের সুপারিশকৃত মাত্রাঃ

১ম সপ্তাহ ২০ গ্রাম/১০০০ পিএল

২য় সপ্তাহ ৪০ গ্রাম/১০০০ পিএল

৩য় সপ্তাহ ৬০ গ্রাম/১০০০ পিএল

৪র্থ সপ্তাহ ৮০ গ্রাম/১০০০ পিএল

সম্পূরক খাদ্য তৈরি

বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে খুব সহজেই মাছ ও গলদা চিংড়ির খাদ্য তৈরি করা যায়। চাষি নিজের হাতেই তা করতে পারেন। সম্ভব হলে মিনসিং মেশিন ব্যবহার করেও খাদ্য তৈরি করা যেতে পারে। নিচে মাছ ও চিংড়ি চাষের পুকুরে প্রয়োগের জন্য মিশ্র খাদ্য তৈরির পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

  • খৈল কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা পূর্বে দ্বিগুণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে উপর থেকে ভাসমান তৈলযুক্ত পানি ফেলে দিতে হবে
  • চালের কুঁড়া, তুখি ও ফিসমিল ভালোভাবে চালুনি দ্বারা ঢেলে নিতে হবে।
  • চালের খুদ ব্যবহার করা হলে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
  • সমস্ত উপকরণগুলো একটি পাত্রে নিয়ে ভালোজাবে মেশাতে হবে।
  • আটা পরিমাণমতো পানিতে ফুটিয়ে আঠালো পদার্থ তৈরি করতে হবে।
  • উপকরণগুলো আঁঠালো পদার্থ যারা মেখে কাই তৈরি করে ছোট ছোট বল বানাতে হবে

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

মাছ দিনের বেলায় খাদ্য গ্রহণ করে। অপরদিকে গলদা চিংড়ি নিশাচর। দিনের আলোর চেয়ে এরা অন্ধকারে চলাচল ও খাদ্য গ্রহণ করতে পছন্দ করে। সেজন্যে কার্প-চিংড়ি মিশ্রচাষের পুকরে প্রতি দিনের প্রয়োজনীয় খাবার দুভাগে ভাগ করে এক ভাগ সকাল ৬ টার আগে এবং আরেকবার সন্ধ্যা ৬ টার পরে প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকবার প্রয়োগের পূর্বে খাবারকে আবার দু’ভাগ করে অর্ধেক খাদ্যদানীতে এবং বাকী অর্ধেক পুকুরের কয়েকটি জায়গা পাট কাঠি দ্বারা চিহ্নিত করে সেখানে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, চিংড়ির জন্য খাদ্য দেয়ার সময় পুকুরের তলদেশ থেকে এক ফুট উপরে খাদ্যদানী স্থাপন করতে হবে।

সবুজ খাদ্য প্রয়োগ

গ্রাসকার্প ও সরপুঁটির খাদ্য বাঁশ বা অন্য কোন উপযুক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি চৌকোণাকার ভাসমান ফ্রেমের মধ্যে দেয়া ভালো। ফ্রেমটি পাড়ের ১-২ মিটার দূরত্বে স্থাপন করতে হয়। ৩০ শতাংশ পুকুরের জন্যে ফ্রেমের সাধারণ মাপ হচ্ছে ১ বর্গমিটায়। পাড়া জাতীয় উদ্ভিদ টুকরো টুকরো করে ফ্রেমের মধ্যে দিতে হয়। খাদ্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার খাদ্য দিতে হবে।

 

গলদা চিংড়ির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা | অধ্যায়-৭ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

খাদ্যদানী

খাদ্যদানী (ট্রে) তে খাবার দিলে খরচ বাঁচে এবং খাদ্যের ব্যবহার যথার্থ হয়। তা ছাড়া খাদ্যের পরিমাণ করাও সহজ হয়। এটির আকার ১ বর্গমিটার অথবা ৮০x৮০ সেমি হতে পারে। বাঁশ বা কাঠের ফ্রেমের নিচে মশারির কাপড় লাগিয়ে ধর্ম জালের মতো করে তা তৈরি করা যায়। ফ্রেমটির উচ্চতা ১০ সেমি রাখা উচিত। ৩০ শতাংশ পুকুরে ২টি, ৬০ শতাংশ পুকুরে ৪টি এবং ১০০ শতাংশে ৬ টি খাদ্যদানী স্থাপন করলেই চলে। খাদ্যদানী ব্যবহার করা হলে তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগের সতর্কতা

  • প্রতিদিন একই সময়ে একই জায়গায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
  • মাঝে মাঝে খাদ্যদানী উঠিয়ে খাবার গ্রহণের পরিমাণ যাচাইপূর্বক প্রয়োগ মাত্রা পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে।
  • পানি অতিরিক্ত সবুজ হলে খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে বা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment